রোজার পরিচয়
আরবি সাওম ও সিয়াম শব্দের অনুবাদ হিসেবে রোজা ব্যবহার হয়ে থাকে। রোজা ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে। পবিত্র কোরআন মজিদে সাওম শব্দটি এক জায়গায় (সূরা মারইয়াম : ২৬) আর সিয়াম শব্দটি ৯ জায়গায় (সূরা বাকারা : ১৮৩, ১৮৭, ১৯৬; সূরা নিসা : ৯২; সুরা মায়েদা : ৮৯, ৯৫; সূরা মুজাদালা: ৪) ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে শব্দ দুটির প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। সাওম ও সিয়ামের মূল অক্ষর একই। লিসানুল আরব অভিধানে বলা হয়েছে, সাওম হলোÑ খাদ্য, পানীয়, বিয়ে ও কথাবার্তা ছেড়ে দেওয়া। মিসবাহুল লুগাত অভিধানে বলা হয়েছে, সাওম : রোজা, কর্মবিরতি, রোজাদার। ইসলামি পরিভাষায় সাওম বা সিয়াম হলোÑ ‘দিনে নিয়তসহ পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা।’ (উমদাতুল কারি শরহে সহিহ বোখারি, ২৬তম খ-, পৃ. ৪৩০)। ‘রোজা হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিশেষ নিয়ত অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা।’ (ইযাহুল মেশকাত, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৬৫৬)।
ইসলাম-পূর্র্ব যুগে রোজা
আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। ইসলামে রোজা ফরজ হওয়াসংক্রান্ত এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম-পূর্ব সব যুগেই রোজার বিধান ছিল। হজরত আলী (রা.) ও হাসান বসরি (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হজরত আদম (আ.) এর যুগ থেকে শুরু করে সব উম্মতের ওপরই রোজা ফরজ ছিল। (ইযাহুল মেশকাত, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৬৫৬)। ইহুদিদের আশুরার রোজা ও হজরত দাউদ (আ.) এর রোজা প্রসঙ্গ হাদিসে বর্ণিত আছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করে। তিনি তাদের এ দিনের রোজার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, এ দিনে মুসা (আ.) ফেরাউনের ওপর বিজয় লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা (মুসলমানরা) মুসা (আ.) এর অধিক নিকটবর্তী। কাজেই তোমরাও রোজা পালন করো। (সুনান আদ-দারিমি, হাদিস নং ১৭৫৯)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, তুমি কি সব সময় রোজা রাখো আর রাতভর নামাজ আদায় করে থাকো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। যে বছরজুড়ে রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না। আর তুমি প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখো, তাই বছরজুড়ে রোজা রাখা বা বছরজুড়ে রোজা রাখার মতো। তিনি বললেন, আমি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাহলে তুমি দাউদ (আ.) এর রোজা রাখো। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন রোজা ছেড়ে দিতেন। তিনি শত্রুর সম্মুখীন হলে পলায়ন করতেন না। (বোখারি : ১৮৭৮)।
ইসলামে রোজার প্রবর্তন
ইসলাম-পূর্ব সব যুগেই রোজার বিধান থাকলেও সে ধারাবাহিকতায় ইসলামে রোজা ফরজ হয়নি। বরং ইসলামে রোজা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের আধার। রহমত, বরকত ও মাগফিরাত দ্বারা সমৃদ্ধ। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভরপুর মাসব্যাপী এ রোজা দ্বিতীয় হিজরিতে ফরজ করা হয়। রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার দ্বিতীয় বছরে শাবান মাসের শেষ দশকে রমজানের রোজা আদায়ের নির্দেশনা আসে। (সিরাতুল মুস্তফা, প্রথম খ-, পৃ. ৪৭)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পুরো করে নিতে হবে। তা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদয়াÑ একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎ কাজ করে, তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানতে। রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পুরো করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না। এজন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩-১৮৫)। অবশ্য রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা (১০ মহররম) এবং ‘আইয়ামে বিয’ তথা চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর সেসব রোজার বিধান নফলে পরিণত হয়েছে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নামাজ তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে এবং রোজাও তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।