আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

যে কারণে টেকেনি ‘ডেট রিকভারি এজেন্ট’

খেলাপি ঋণ আদায়ে আবার হচ্ছে কোম্পানি

মৌসুমী ইসলাম
| প্রথম পাতা

খেলাপি হওয়া ঋণের অর্থ আদায়ে ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু করে ‘ডেট রিকভারি এজেন্ট’। ২০০৩ সাল থেকে জোরেশোরেই মাঠে নামে অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য ছিলÑ অনাদায়ী মন্দ ও কুঋণ এবং মামলায় আটকে থাকা খেলাপি ঋণ উত্তোলন। এমন ব্যবস্থায় আদায়ও হয় বড় অঙ্কের অর্থ। কিন্তু ঋণের অর্থ তুলে দেওয়ার পর কোম্পানিকে কমিশন দেওয়া নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়। পরে ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগ। এক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ে ব্যাংকের কিছু অসৎ কর্মকর্তা। বেশ কয়েক বছর পর খেলাপি হয়ে যাওয়া অর্থ তুলতে সেই ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ ধারণা চালু করতে চায় সরকার। কমিটি গঠন করে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়েই কাজ করবে এ কোম্পানি। এরই মধ্যে একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে নানা দিক তুলে ধরা হয়। সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ কমিশন দেওয়ার প্রস্তাব করে সুপারিশ দেয় এ সংক্রান্ত কমিটি।

খেলাপির কারণে গভীর সংকটে ব্যাংকিং খাত। এসব ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিচ্ছে ব্যাংক, কিন্তু মিলছে না আশানুরূপ ফল। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, তারপর উত্তোলন করা যাচ্ছে না সে অর্থ। এভাবে এখন মোট খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। সংকটের সময়ে ঋণের অর্থ তুলে দিতে ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ ধারণা চালু করতে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আইনগত নানা দিক খতিয়ে দেখতে চলেছে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ।
খেলাপি ঋণ আদায়ে ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু করে ‘ডেট রিকভারি এজেন্ট’ পিডিএসসি। ২০০৩ সালে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে কিছু শর্তসাপেক্ষে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম শুরু হয়। পরে আরও কিছু সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে এজেন্ট নিয়োগে ঋণ আদায় কাজ আরও জোরদার করা হয়। ওই সময় পিডিএসসি লিমিটেড ছাড়া আরও তিন প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করে। পিডিএসসি তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তোলন করে দেয় খেলাপি হওয়া ২২৮ কোটি টাকা। ৬১ কোটি টাকা খেলাপির অর্থ তুলে দেওয়ার পরও কমিশনের ৬ কোটি টাকা সংস্থাটিকে পরিশোধ করেনি সোনালী ব্যাংক। বিষয়টি সাবেক অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করা হলে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। 
যেভাবে রিকভারি এজেন্টের যাত্রা শুরু : দেশে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ‘দি পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড’ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি কর্তৃক নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে সোনালী ব্যাংক ও পরে ন্যাশনাল, পূবালী, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, অগ্রণী, মার্কেন্টাইল কো-অপারোটিভ, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা, কেয়ার বাংলাদেশ ও সিএসপি হান্টার লন্ডনের খেলাপি ঋণ আদায় করে। ব্যাংকগুলো থেকে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত অনাদায়ী মন্দ ও কুঋণ, মামলায় আটকে থাকা খেলাপি ঋণের হিসাবগুলো পিডিএসসির এজেন্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া বন্ধকী জমি, মালিকানায় সম্পত্তি বিরোধÑ এমনকি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকেই রাখার ফলে চুক্তিবদ্ধ এজেন্ট ইচ্ছা করলেই মামলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এছাড়া ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্যানেল আইনজীবী ঋণখেলাপির সঙ্গে যোগসাজশে মামলা দীর্ঘায়িত করে। 
খেলাপি ঋণ উত্তোলনে দুটি সাফল্য : কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল সরকারি মালিকানাধীন একটি টেক্সটাইল মিল। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের লিকুইডেশান সেল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানটি শত শত কোটি টাকার সম্পদ মাত্র ৪৮ কোটি টাকায় শাহমখদুম নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। ক্রেতা মাত্র ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে মিল দখল নেয়। নাম পরিবর্তন করে সরকারি সম্পত্তি বন্ধক না রেখে রাষ্ট্রীয় অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৭ কোটি টাকার ঋণ নেয়। পিডিএসসির ঋণ আদায়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণগ্রহীতার সম্পদ বিক্রি করতে চাইলে স্বয়ং অগ্রণী ব্যাংক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১১ কোটি টাকা আদায়ের পর ব্যাংক ঋণ হিসাবটি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সিতাকু- অঞ্চলে মেসার্স মকবুল মিলের শতকোটি টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয় সোনালী ব্যাংক। পরে পিডিএসসিকে ঋণ উত্তোলনে দায়িত্ব দেওয়া হলে আলোচনার ভিত্তিতে মিল বিক্রি করে দেনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়। 
সাবেক অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগ : সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পরামর্শে তৎকালীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব খেলাপি ঋণ আদায়ে এজেন্টের গুরুত্ব বিষয়ে আইনি বিধিমালা প্রণয়নের জন্য সব ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। সর্বশেষ বৈঠকে খেলাপি ঋণ আদায়ে এজেন্ট ব্যাংকিং কোম্পানি আইন-২০১৫ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বিষয়টি আলোর মুখ না দেখায় অর্থ উপদেষ্টা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে দিলে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
আবার আলোচনায় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি : অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে সুপারিশ করা হয়, সবচেয়ে খারাপ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হবে। যেসব খেলাপি ঋণ ব্যাংক আদায় করতে ব্যর্থ হবে কেবল সে কুঋণই বেসরকারি খাতে গড়ে তোলা এ কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হবে। যদি এ কোম্পানি খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারে তবে আদায়কৃত ঋণের অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হবে কোম্পানিকে। এজন্য করা হবে নতুন একটি আইন, যার নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘সিকিউরিজেশন অব নন-পারফরমিং লোন’। এ আইন বলে ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ঋণ খেলাপির প্রতিষ্ঠান দখলে নিতে পারবে। 
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে তদারকির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করা গেলে ব্যাংকিং খাতের জন্য তা হবে ইতিবাচক। তবে এজন্য ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এর আগে ডেট রিকভারি এজেন্ট কাজ শুরু করে এবং তারা ঋণ উত্তোলনে প্রথমদিকে ভালো সাফল্য দেখায়। কিন্তু কমিশন দেওয়া নিয়ে ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারেনি। এখন আবার এমন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হলে তার জন্য ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। কারণ ঋণগুলো কিনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যদি ঘুষ দাবি করে, কিন্তু এ উদ্যোগের সুফল মিলবে না। তবে অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা চালু আছে।