একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাসের মাথায় নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিএনপির এমপিদের শপথগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। বিএনপির শীর্ষ অনেক নেতা এবং শরিকদের না জানিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে নানা ক্ষোভ ও প্রশ্ন। ফল প্রত্যাখ্যান করা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে যোগ দেওয়ার পর বিএনপি জোটের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন ও অন্ধকারে রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত জোটের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা আরও কিছুদিন পর স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শেষ মুহূর্তে বিএনপির সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তটি ‘কনফিউশন’ তৈরি করলÑ এটা তো ঠিক। তবে এ সিদ্ধান্তের কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা দেখতে আরও অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করি। গেল বছর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনে মাত্র আটটি আসনে জিততে পারা বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরমধ্যে বিএনপির ছয়জন এবং গণফোরামের দুইজন নির্বাচিত হন। তবে এ নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে এর ফল ও শপথ অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপর থেকেই শপথগ্রহণের শেষ সময় পর্যন্ত কী হয় তা পর্যবেক্ষণে ছিলেন সরকার ও রাজনৈতিক মহল। শুরু থেকেই দলীয় ও জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
এক পর্যায়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুইজনের মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ৭ মার্চ এবং সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান ২ এপ্রিল জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথগ্রহণ করেন। এতে বিএনপি জোটে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সুলতান মনসুরকে গণফোরাম ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর মোকাব্বির খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
গণফোরামের পর বিএনপির ছয় এমপিরও শপথের সম্ভাবনার কথা জোরদার হলেও দলটি থেকে তা দৃঢ়ভাবে নাকচ করা হচ্ছিল। এরই মধ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ২৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান শপথ নেন। এ ঘটনায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
কিন্তু এর চার দিনের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শপথগ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল হক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ। শপথগ্রহণের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান তারেকের নির্দেশে দলীয়ভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে শপথ থেকে তিনি নিজে বিরত থাকেন। একপর্যায়ে তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। আকস্মিক এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে এখনও নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি সংসদে যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে।
হঠাৎ করে বিএনপির এ অবস্থান বদলকে সঠিক মনে করছেন না নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান। চারজনের শপথগ্রহণের পেছনে কোনো সমঝোতা আছে কিনা, তা খোলসা করার আহ্বান জানান মাহমুদুর রহমান মান্না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে ঐক্যফ্রন্টের এ নেতা বলেন, যদি সমঝোতা হয় তা হলে সেই সমঝোতাটা খোলাখুলি বলেন, কী সমঝোতা হয়েছে? তিনি বলেন, আমি সবার কাছে বলতে চাই, আমাদের লড়াই ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। আপসকামিতায়-সহযোগিতায়-সহমর্মিতায়-সমঝোতায় আপনি জিততে পারবেন না।
তার প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, বিএনপি সমঝোতা করলে অনেক আগেই সমঝোতা করতে পারত। খালেদা জিয়া যদি সমঝোতা করতেন তাহলে উনি প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন নাÑ এ কথাগুলো আপনাদের মনে রাখতে হবে।
শপথের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তাদের এ সিদ্ধান্ত বদল রাজনীতির চমক, একে ইউটার্ন হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়। ফখরুল বলেন, আমরা যে শপথ নিয়েছি, এর জন্য অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কিন্তু সময়ই প্রমাণ করবে, শপথ নেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত কি না। আগে আমরা শপথ নিইনি, তার মানে এখন নেব নাÑ তা তো হতে পারে না। তিনি বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলে নয়, বিশ্ব রাজনীতি দেখে আমরা সংসদে গিয়েছি। কথা বলার ন্যূনতম যে সুযোগ এটা কাজে লাগাতে দানবকে পরাজিত করার জন্য শপথ নিয়েছি। তার শপথ না নেওয়াটাও দলীয় সিদ্ধান্তেই, এটা তাদের কৌশলেরই অংশ বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।
বিএনপির সংসদে যোগদান প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমান বলেন, এটি একান্তই বিএনপির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে জোটগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ নেওয়া হয়নি। হঠাৎ করে কীভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা জোটের পরবর্তী বৈঠক হলে জানতে পারব। তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি হাইকমান্ড নানা বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ পরিবর্তন করায় বিএনপি হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব নেতার বক্তব্য কতটা কার্যকর হবে তা চিন্তার বিষয়। এ সিদ্ধান্ত হটকারিতা হয়েছে বলে বিএনপি নেতাকর্মী এবং দেশবাসী মনে করছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং গণফোরামের মিডিয়া সমন্বয়ক লতিফুল বারী হামিম বলেন, বিএনপির এমপিদের শপথ নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কিছুই জানেন না। বিএনপি জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথ নেওয়ায় গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অপর নেতা মোকাব্বির খানকে শোকজ করা হয়েছে। এমনকি একই অপরাধে বিএনপিও তাদের একজনকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু বিএনপির অপর এমপিদের শপথের সিদ্ধান্তের পর এসব নেতাদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে তা নিয়ে জটিল সমীকরণ দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপির আকস্মিক সিদ্ধান্ত বদলের ভালো-মন্দ সম্পর্কে মন্তব্য করতে আরও অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক হলেও স্পষ্ট হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।