আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৫-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

বিশ রমজান মক্কা বিজয়ের বার্ষিকী

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
| প্রথম পাতা

হিজরী ৮ম সালে মক্কা বিজয় ছিল আরবের তাবৎ কুফরি শক্তির ওপর মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয়। এ অভিযানের সর্বাধিনায়ক ছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)। ১০ রমজান মহানবী (সা) মদিনা হতে ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হন এবং প্রায় বিনাযুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন করেন। এ অভিযানের পটভূমি ছিল, হিজরি ৬ সালে মক্কার অদূরে হুদাইবিয়ায় কুরাইশ ও রাসূলুল্লাহর মধ্যে ১০ বছর মেয়াদি একটি শান্তি ও অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২১ মাসের মাথায় কুরাইশরা নিষ্ঠুুর পন্থায় এ চুক্তি লঙ্ঘন করে। পরক্ষণে তারা ভুল বুঝতে পেরে চুক্তি নবায়নের চেষ্টা করে; কিন্তু রাসুল (সা) তাতে রাজি হননি। তিনি অতি গোপনীয়তায় অভিনব পন্থায় ১০ হাজার যোদ্ধা  নিয়ে অগ্রসর হন। মহানবী (সা)-এর মক্কা অভিযানের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ও সমর কুশলীসুলভ অনন্য উদাহরণ ও সুন্নাত। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মুসলিম বাহিনী যখন মক্কার উপকণ্ঠে ‘মাররুয যাহরান’ এ পৌঁছে, তখন সন্ধ্যা নেমে আসে। নবী করীম (সা) সঙ্গীদের হুকুম দিলেন, প্রত্যেকে রাতের রান্নাবান্নার জন্য আলাদা আগুন জ্বালো। ১০ হাজার উন্মুক্ত চুলোয় আগুন জ্বলে উঠলে বিশাল 

প্রান্তরভূমি দূর থেকে আগ্নেয়গিরির দৃশ্য ধারণ করে। শত্রু শিবিরে ভীতি সঞ্চার করে যুদ্ধ এড়ানোর এ কৌশল ও সুন্নাত ছিল অভিনব। কুরাইশ গোয়েন্দারা রাতের এ দৃশ্য দেখে রিপোর্ট করলে তারা মুসলমানদের প্রতিরোধের সব মনোবল হারিয়ে ফেলে। 
নবীজি আরও নির্দেশ দেন, প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার অস্থায়ী শৌচাগারের সংখ্যা হবে খুবই সীমিত। পরদিন ভোরবেলা দেখা গেল, মুসলমানদের শৌচাগারমুখী সুদীর্ঘ লাইন। শত্রু গোয়েন্দারা হতভম্ব হয়ে ভাবল, সকাল বেলা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার লাইন যেখানে এত দীর্ঘ, না জানি কত বিশাল বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ (সা) এসেছেন মক্কা আক্রমণ করতে। রাতের গোয়েন্দা মিশনে এসে শত্রু বাহিনীর প্রধান আবু সুফিয়ান পাকড়াও হওয়া এবং হত্যার পরিবর্তে তার প্রতি অভাবিত সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। 
নবীজির নির্দেশে মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশের দৃশ্যটি উপভোগ করছিলেন হযরত (সা)-এর চাচা আব্বাস (রা) একটি উঁচু টিলার উপর সদ্য ঈমান আনয়নকারী কুরাইশ সরদার আবু সফিয়ানকে পাশে বসিয়ে। আবু সুফিয়ানের মন্তব্য ছিল, তোমার ভাতিজার রাজত্ব বিরাট সালতানাতে পরিণত হয়েছে। হজরত আব্বাস আবু সুফিয়ানের মন্তব্য শোধরে দিয়ে বলেন, চুপ কর, এটি সালতানাত নয়, নবুয়াত। সত্যিই ইসলামের রাজনীতি সমরনীতি আল্লাহর ইবাদত হিসেবেই নিবেদিত।
নবীজি প্রায় বিনাযুদ্ধে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন, যা ছিল তাঁর জন্মস্থান। যেখানকার অধিবাসীরা ১৩ বছর চরম নির্যাতন করে তাকে হত্যার মহড়া দিয়েছিল, দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। মদিনায় গিয়েও শান্তিতে থাকতে দেয়নি একদিনও। বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সব চেষ্টা করে এখন তারা ব্যর্থ, পরাজিত। এসব অপরাধ ও জুলুমের  প্রতিশোধ নেয়ার আজকেই বুঝি মোক্ষম সুযোগ। 
নবীজি প্রথমে আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করলেন। তারপর আল্লাহর ঘরে স্থাপিত মূর্তিগলো অপসারন করে একত্ববাদের মহিমা ঘোষণা করলেন। নানা অজুহাতে অসংখ্য শত্রুর জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করলেন। আর সমবেত মক্কাবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘আজকের দিনে তোমাদের ওপর কোনো প্রতিশোধ নেই। তোমরা সম্পূর্ণ মুক্ত।’ শত্রুর প্রতি এমন উদারতা, এভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২০ রমজান শুক্রবার মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে ইসলামের যুদ্ধ ও রাষ্ট্রনীতির অনুপম সৌন্দর্য অনন্তকালের জন্য দুনিয়াবাসীর সামনে উদ্ভাসিত হয়। 
পবিত্র মাহে রমজানে নবী করিম (সা) পরিচালিত আরেকটি যুদ্ধাভিযানের নাম বদর যুদ্ধ। এসব ইতিহাস মুসলমানদের জাতীয় জীবনের জন্য আলোকবর্তিকা। জাতীয় গৌরব ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন জাতি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। স্মৃতিসৌধের পাদদেশে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্ম অতীতের গৌরবগাথার স্মৃতি রোমন্থন করে, নতুন মনোবলে উজ্জীবিত হয়। ভাস্কর্য শিল্পের চেয়ে ইতিহাসের স্বর্ণরেখাই ইসলামের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বদরযুদ্ধ ও মক্কাবিজয়সহ ইসলামের গৌরবোজ্জল ঘটনাগুলো কোরআন হাদিস ও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত ও জ্বলজ্বল করছে। আমরা সাওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করি; এর সাথে যদি জাতীয় জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যত রচনায় কোরআন হাদিসে বর্ণিত ইতিহাসের পটভূমিতে না দাঁড়াই, তার  গোনাহের পরিমাণ নিশ্চয়ই তেলাওয়াতের সওয়াবের চেয়ে বেশি হবে।