ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার চার্জশিটে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আসামিদের সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। অভিযুক্ত ১৬ জনের মধ্যে এজাহারনামীয় আটজন। আজ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৬ জনের মৃত্যুদ- চেয়ে ৭২২ পৃষ্ঠার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানিয়েছেন।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলেন, এ ঘটনায় চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা হত্যাকা- ঘটিয়েছে। কেউ নির্দেশ দিয়েছে, কেউ গেট পাহারা দিয়েছে আবার কেউ সাইক্লোন শেল্টার পাহারা দিয়েছে। আর কেউ থানা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পালন করেছে। তারা প্রত্যেকেই এ হত্যাকা-ের জন্য সমান দায়ী। এছাড়া নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি পাঁচজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
পিবিআই প্রধান বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে, এ মামলার আসামিরা কেউ ছাড় পাবে না। বিচার চলাকালে আদালতে সব আসামি উপস্থিত থেকে নিজ চোখে তাদের বিচার দেখবে। আমরা এটা পেরেছি। ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা উল্লেখ করে মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে ১৬ জন একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। তিনি আরও বলেন, অপকর্মের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৬ জনের প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে এ হত্যাকা- ঘটায়। ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণিপেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা গেছে। শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী। খুনের পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষাও যে দেওয়া সম্ভব তা ভাবনাতীত। আসামিরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৬ জনের মধ্যে ১২ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। জবানবন্দি ও তদন্তে ১৬ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আমরা এ ১৬ জনের মৃত্যুদ-ের দাবি জানিয়েছি। এ মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানসহ মোট ৯২ জনকে অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হচ্ছে। তার মধ্যে সাতজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য কেরোসিন তেল বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন, নুসরাতের গায়ে সেই কেরোসিন ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত একটি কাচের গ্লাস, দেশলাইয়ের কাঠি, তিনটি কালো রঙের বোরকা, আসামি শামীমের ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন, আসামি রুহুল আমীনের সঙ্গে তার কথোপকথনের রেকর্ড এবং অধ্যক্ষের অপকর্মের বিবরণ লেখা নুসরাত জাহান রাফির ডায়েরি এ মামলার আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
অভিযুক্ত ১৬ জনের কার কী ভূমিকা ছিল
এসএম সিরাজউদ্দোলা : হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ না নিলেও এর চেয়ে বেশি করেছেন। তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। তাতে কাজ না হলে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা দেন তিনি। কীভাবে হত্যা করতে হবে তারও নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও দেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।
নুর উদ্দিন : হত্যাকান্ডের আগে যে কক্ষে বোরকা রাখা ছিল, সেটি পরিদর্শন করে আসেন তিনি। ঘটনার সময় ভবনের নিচের পরিস্থিতি তিনি খুব চতুরতার সঙ্গে সামলে নেন। পুরোটা সময় নাটকের মতো চিত্রায়ণ করতে সহায়তা করেন।
শাহাদাত হোসেন শামীম : হত্যাকা-ের আগে পরিকল্পনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শামীম। কীভাবে কে কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা সাজান শামীম। তিনি কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন। যে টাকা দিয়ে বোরকা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পরে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত বোরকা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাস উদ্ধার করা হয়।
মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর : ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন। হত্যাকা-ের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা দেন। সব কিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেনীতে অবস্থান করছিলেন তিনি।
সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের : তিনি ঘটনাস্থলে নুসরাতকে শোয়ানোর পর পা বেঁধে দেন। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন : তিনি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালেন। নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুবই ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে চলে যান। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যান, এমনভাব করে যেন কিছু জানেন না।
হাফেজ আবদুুল কাদের : তিনি নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহারায় ছিলেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না, নোমান দেখতে চাইলে কাদের তাকে বাধা দেন। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয় জানতে চাইলে কাদের জানান, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে তিনি জানান, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
আবছার উদ্দিন : ঘটনার সময় তিনি গেট পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও আগের মামলার বাদীকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন।
কামরুন নাহার মণি : শামীম তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে বোরকা ম্যানেজ করতে বলেন। এ টাকায় দুটি বোরকা ও হাতমৌজা কেনেন। কেনা দুইটি বোরকাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরকা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসেন। ছাদে ওঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করেন এবং বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ঘটনার পর ঠান্ডা মাথায় এসে তিনিও পরীক্ষায় অংশ নেন।
উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা : নুসরাতকে ছাদে ওঠানোর পর মামলা তুলে নিতে প্রথমে চাপ দেন তিনি। রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ের ওড়নাটি বের করেন পপি। এরপর ওড়নাটি ২ ভাগ করে দেন, যা দিয়ে নুসরাতে হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছন দিয়ে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়। যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।
আবদুর রহিম শরীফ : তিনি বাইরের গেটে পাহারায় ছিলেন। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন তিনি।
ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল : তারা গেটে পাহারায় ছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক বোঝাতে যা যা করণীয় তা করছিলেন তারা।
মোহাম্মদ শামীম : তিনি প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিলেন। যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে এবং এর ফলে অন্য কাউকে খুন করতে না হয় সে জন্য সতর্ক ছিলেন তিনি।
রুহুল আমিন : ঘটনার পর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ-প্রশাসন সবকিছু ম্যানেজ করার আশ্বাস দেন তিনি। হত্যাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেন। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দুই দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত হন।
২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল নুসরাতকে কৌশলে ওই মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা। সেখানে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মামলা করে। ওই মামলার ১০ এপ্রিল তদন্তভার পায় পিবিআই।