logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শনিবার, মার্চ ১২, ২০১৬
যদি আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়, তখন অন্ধলোকের অন্তরও আলোকিত, খোদায়ী তত্ত্বজ্ঞানে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ হিসেবে মওলানা রুমি প্রাকৃতিক জগৎ থেকে নানা উদাহরণ চয়ন করে বলছেন, মাটির পৃথিবীর চেয়ে দৃষ্টিহীন অন্ধ আর কিছু হতে পারে না
অন্ধ ভিখারি, ভাগ্যবান কুকুর
মওলানা রুমির মসনবি শরিফ

এক অন্ধ ভিখারী এক গলি দিয়ে যাচ্ছিল। গায়ে ছিল ঝুলমুল কাপড়। দেখে এক বেয়াড়া কুকুর হামলে পড়ল ভিক্ষুকের উপর। কুকুর তার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলল টানাটানি করে। ভিখারি তখন অসহায়। মারমুখো সিংহের মতো হামলে পড়া কুকুরকে বারণ করার শক্তি তার  নেই। অবশেষে পরাভব মেনে কুকুরকে সে বলল, ওহে শিকারি কুকুর প্রবর হামলা করা কি উচিত হলো তোমার আমার উপর? তোমার জন্য তো এ কাজ মোটেও শোভন নয়। আমার মতো অসহায় দুর্বলকে আক্রমণ করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নাই। দেখ, তোমার বন্ধুরা প্রান্তরভূমিতে জেব্রা শিকার করছে। আর তুমি এক অন্ধ ভিক্ষুক পেয়ে আক্রমণ চালাচ্ছ। 
“গূর মী গীরন্দ য়া’রা’নাত বে দাশ্ত
গূর মী গীরি তো দর কূয় ইন বীদস্ত”
‘জেব্রা খোঁজে তোমার সঙ্গীরা বনে শিকারে গিয়ে
তুমি এই অন্ধকে খামছাও গলিতে অসহায় পেয়ে।’
হ্যাঁ, আসল ব্যাপার হলো তুমি জ্ঞানের আলো পাওনি। দীক্ষা নাওনি। তাই জেব্রার বদলে অন্ধকে কামড়াও। নচেৎ দেখ গিয়ে, প্রশিক্ষণ পাওয়া কুকুর কীভাবে বনে পশু শিকার করছে। তার কারণ, শিকারি কুকুর জ্ঞানলাভ করেছে, দীক্ষা পেয়েছে, ভালো-মন্দ ফারাক করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আর তুমি সে তরবিয়ত পাওনি।
“ইলম চোন আ’মূখত সাগ রাস্ত আয দ্বালা’ল
মী কুনাদ দর বীশেহা’ সাইদে হালাল”
‘কুকুর যখন শেখে জ্ঞান, নিস্তার পায় গোমরাহী হতে
সে তখন হালাল জন্তু শিকার করে প্রান্তর ভূমিতে।’
“সাগ চো আ’লেম গশ্ত শুদ চা’লা’কে যাহ্ফ
সাগ চো আ’রেফ  গশ্ত শুদ আসহা’বে কাহ্ফ”
‘বিদ্যা অর্জন করেছে কুকুর তাই সে চালাক বিচক্ষণ,
দিব্যজ্ঞানে হয়েছে কুকুর আসহাবে কাহাফের বন্ধুজন।’
গল্পের সূত্রপাত অন্ধ ভিখারির ওপর কুকুরের হামলা দিয়ে। অসহায় ভিক্ষুক তখন কথা বলে মারমুখো কুকুরের সঙ্গে। এর ধারাবাহিকতায় মওলানা রুমি (রহ.) তার তত্ত্বদর্শন ব্যক্ত করেছেন এভাবে কুকুর দুই ধরনের। এক ধরনের বেয়াড়া বেয়াদব, অলিগলিতে ঘুরে উচ্ছিষ্ট খোঁজে। কিন্তু যে কুকুর জ্ঞানলাভ করে, প্রশিক্ষণ পায় তার মূল্য অনেক। এরূপ প্রশিক্ষিত শিকারি কুকুর পচা, দুর্গন্ধযুক্ত বা হারাম খাদ্য খায় না। বরং বনপ্রান্তরে হালাল পশু-পাখি শিকার করে মনিবের কাছে নিয়ে আসে। শুধু কি তাই; কুকুর আধ্যাত্মিক সিদ্ধিও অর্জন করতে পারে। দিব্যজ্ঞান লাভকারী এ কুকুরের মর্যাদা তখন অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়। আসহাবে কাহাফের সঙ্গে হয় তার বসবাস। কোরআন মজিদের বর্ণনা মতে, বনি ইসরাইল বংশে আল্লাহতে বিশ্বাসী একদল যুবকের সঙ্গী হয়ে একটি কুকুর কয়েকশ’ বছর ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দেয়। কোরআন মজিদে উল্লেখের ফলে পরিপূর্ণ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় আসহাবে কাহাফের সেই কুকুর। মওলানা এখানে নফসের প্রশিক্ষণের তাগিদ দিয়ে বুঝিয়ে বলছেন
“সাগ শেনা’সা’ শুদ কে মীরে সেইদ কীস্ত
আই খোদা অ’ন নূরে এশনা’সান্দে চীস্ত।”
‘কুকুর চিনল শিকারের রাজা-পরিচয় আসল মালিকের
হে খোদা! আমাদের দাও সে আলো আত্মপরিচয় লাভের।’
মওলানা বলছেন, শিকারি কুকুর যেমন তার শত্রু-মিত্র চেনে, তেমনি আসহাবে কাহাফের কুকুর চিনেছে তার আসল মনিব। তাই সে আল্লাহর পরিচয় লাভে ধন্য। কতই সৌভাগ্যবান সেই কুকুর। প্রভু হে! আমাকে দাও সেই আলো, সেই জ্যোতি, সেই দিব্যজ্ঞান। যাতে চিনতে পারি তোমাকে। 
অন্ধ ভিখারির সূত্রে মওলানা প্রকৃত অন্ধ কে, সে পরিচয় তুলে ধরতে চান। মওলানা বলেন, যাদের জাহেরি চোখ নেই, দুনিয়ার রঙ-রূপ দেখতে পায় না, তারা প্রকৃত অন্ধ নয়। কারণ, বহু অন্ধলোক আছে, যাদের অন্তর্জগৎ আলোকিত, মারেফতের জ্ঞানে উদ্ভাসিত। আর এমন অগণিত চক্ষুষ্মাণ ব্যক্তি আছে, যাদের দিব্যদৃষ্টি নেই। অন্তর অমাবস্যার অন্ধকার রজনী। অভিজ্ঞতা প্রমাণ দিয়েছে, অন্তর যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন দিব্যজ্ঞানের অভাব দেখা দেয়, চিন্তা ও মননে বক্রতা জন্মে, যত খারাপ চিন্তা মাথায় এসে বাসা বাঁধে। অথচ তাদের জাহেরি  চোখে দৃষ্টিশক্তির অভাব নেই।
আর যদি আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়, তখন অন্ধলোকের অন্তরও আলোকিত, খোদায়ী তত্ত্বজ্ঞানে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ হিসেবে মওলানা রুমি প্রাকৃতিক জগৎ থেকে নানা উদাহরণ চয়ন করে বলছেন, মাটির পৃথিবীর চেয়ে দৃষ্টিহীন অন্ধ আর কিছু হতে পারে না। অথচ আল্লাহর দয়ার সংযোগ হলে এ মাটি দৃষ্টিমান হয়, ফারাক করে চিনে নেয় দোশত-দুশমন, আপন-পর।
নূূরে মূসা দীদ-ও- মূসা’ রা’ নওয়াখ্ত
খস্ফে কা’রুন কর্দ কারুন রা’ শেনা’খ্ত”
‘মুসার নূর দেখল মাটি করল মুসার সমাদর,
কারুনকে গিলে খায় পেটে, চিনে আল্লাহর দুশমন, পর।’
পৃথিবীর মাটি যা দেখতে অন্ধ, তা আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) এর প্রতি খাতির দেখাল; অথচ অজস্র সম্পদের দর্পিত মালিক কৃপণ কারুনকে গিলে ফেলল নিজের গহ্বরে। আল্লাহর ইশারায় পৃথিবীতে ভূমিকম্প, বান, তুফান, ধ্বংসলীলাও মাটির এ বিচক্ষণতার ফল। মওলানা বলেন 
“খা’কো আ’বো বা’দো না’রে বা’ শরর
বে খবর বা’ মা’ ওয়া বা’ হক বা’ খবর”
‘মাটি, পানি, বায়ু আর লেলিহান আগুন
আমাদের সাথে অচেতন, আল্লাহর সাথে করে আলাপন।’
“মা’ বে আক্সে অ’ন যে গাইরে হক খবীর
বী খবর আয হক্কো যে চান্দীন নযীর”
‘এর বিপরীতে আমরা আল্লাহ ছাড়া সবার খবর রাখি,
আল্লাহর খবর রাখি না, উদাসীন যত আসুক সতর্ককারী।’
আল্লাহর খবর যারা রাখে না, তাদের বাহ্য-ইন্দ্রিয় যদিও প্রখর, তারা জ্ঞানী, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান; কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় না থাকায় তারা অন্ধ, নিজের ভেতরের খবরও তাদের নেই।
“কূরদিল বা’ জা’নো বা’ সাম্ও বসর
মী নাদা’নদ দুয্দ শয়তা’ন রা’ যাসার”
‘যে অন্ধদিল তার প্রাণ, কান, চোখ থাকা সত্ত্বেও
চিনে না চোর শয়তান, শয়তানি পদচিহ্ন দেখে।’
অন্তর যদি কালো হয়, আঁধারে চেয়ে থাকে, তাহলে দেহে প্রাণ, শোনার কান ও প্রখর দৃষ্টিশক্তি থাকলেও আসল শত্রুকে চিনতে পারে না সে। সবকিছু দেখে, শোনে, বুঝে সত্য। কিন্তু চোর, শয়তান দেহ ও মনের গৃহের ভেতরে ঢুকে যেসব কিছু লুট করে নিয়ে যায়, টের পায় না, সে খবর থাকে না তার কাছে। তাই মহান আল্লাহর কাছে আকুতি জানাই, তিনি যেন দিব্যজ্ঞান দিয়ে আলোকিত করেন আমাদের জীবন-মন। 
অন্ধ ভিখারি ও দুষ্ট কুকুরের ছোট্ট উপমায় সুউচ্চ আধ্যাত্মিক ভাব, শিক্ষা ও চেতনার উজ্জীবন ঘটানোর এমন কৃতিত্বের জন্যই মওলানা রুমি (রহ.) বিশ্বসাহিত্যে অমর আর তার বাণী অমিয়, অমৃত।

 

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

(সূত্র : মসনবি শরিফ, ২য় খন্ড
বয়েত নং ২৩৫৪-২৩৮৫)

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]