logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শনিবার, মার্চ ১২, ২০১৬
পরিবেশ রক্ষা আইনের বাস্তবায়ন আবশ্যক
আলতাফ হোসেন খান

সহনশীলতার পরিবেশ বাস্তবায়নে সরকারের পরিবেশ দূষণ আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। আইনের বেড়াজাল টপকিয়ে কিছু অসচেতন ব্যক্তি আমাদের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রতিদিন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এ নিয়ে সরকার মোটামুটি নির্বিকার। আইন করেছে, বাস্তবায়ন নেই। নেই কোনো সমন্বয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর মধ্যে।
আদিবাসী আমেরিকানদের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘আমরা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পৃথিবীর উত্তরাধিকার পাইনি। বরং অনাগত প্রজন্মের কাছ থেকে ধার করেছি।’ অর্থাৎ ইচ্ছেমতো এ পৃথিবীর ক্ষতি করার অধিকার কারও নেই। মানুষ শুধু এটার রক্ষক। এটাকে অক্ষত অবস্থায় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে হন্তান্তর করতে হবে। প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে থেকে অশিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে পরিবেশের প্রতি যে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পৃথিবীর অনেক শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এর সুফল ভোগের পরও নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধের সেই প্রেরণা খুঁজে পায় না। তাই নিজেরটুকু বুঝে নিয়ে ইচ্ছেমতো দূষিত করে পরিবেশ অথচ দূষণমুক্ত পরিবেশে বসবাস করার অধিকার আজ একটি সর্বজন স্বীকৃত মানবাধিকার। মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক দলিলপত্রেই শুধু নয়, আঞ্চলিক সমঝোতা, ঘোষণা কিংবা চুক্তিপত্রেও এ অধিকারের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। পরিবেশগত মানবাধিকারের ধারণা এখন বিভিন্ন দেশের সংবিধানেও স্থান পাচ্ছে। কনভেনশন অন রাইটস টু চাইল্ডের (১৯৮৯) ২৪(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রোগব্যাধি ও অপুষ্টি মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের সময় পরিবেশের ক্ষতি ও ঝুঁকির কথা মাথায় রাখতে হবে।’
বাংলাদেশে বর্তমানে পরিবেশবিষয়ক প্রায় অনেক আইন কার্যকর আছে। তবে ৩১ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, শরীর, সুনাম ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রদান করা হয়েছে, যাতে বৃহৎ অর্থে দূষণমুক্ত পরিবেশ লাভের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত।
পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে ওয়াটার পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স জারি করা হলেও মূলত এরপর থেকেই বুড়িগঙ্গার পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত ও দুর্গন্ধময় হচ্ছে। দুই তীরের অসংখ্য কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে এ নদীতে। টোকাই, ভবঘুরে এবং নিম্নআয়ের অনেক মানুষ এ নদীর পানিতে গোসল করছে, খাচ্ছে, রান্নাবান্নায় ব্যবহার করছে আর আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে এ দূষিত নদী। মামলাও হচ্ছে না কারও বিরুদ্ধে। ১৯৭৭ সালে করা হয়েছে এনভায়রনমেন্ট পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স।
পরিবেশ দূষণ রোধে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে। আইনটির ২ ধারায় পরিবেশ দূষণের দীর্ঘ একটা সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এর প্রথমদিকে বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণ বলতে বায়ু, পানি ও মাটির দৈহিক, রাসায়নিক অথবা জৈবিক দূষণ ও পরিবর্তনকে বোঝাবে এবং যার মাধ্যমে এগুলোর তাপমাত্রা, স্বাদ, ঘনত্ব অথবা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয় সেগুলোও দূষণের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ সংজ্ঞার প্রথমেই পরিবেশ দূষণ বলতে বায়ু, পানি ও মাটিদূষণের কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
পরিবেশ আইন ভঙ্গের আর একটি দৃষ্টান্ত হলো মোটরযানে কালো ধোঁয়া নির্গমন। কালো ধোঁয়া নির্গমন করে এমন যানবাহন কেউ চালালে তার মালিক বা ড্রাইভার উভয়কেই শাস্তির বিধান আছে আইনে। অথচ রাস্তায় বের হলেই যত্রতত্র চোখে পড়বে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পের গাড়িগুলোতেই কালো ধোঁয়া বেশি বের হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে এমন মোটরযান অহরহ চলাচল করে; কিন্তু জরিমানা বা মামলা করার কোনো মাথাব্যথাই নেই ট্রাফিক পুলিশের। লাভ কী হলো এরূপ আইন তৈরি করে, যদি আইনের বাস্তবায়ন না করা হয়
আইন অনুযায়ী পরিবেশ আদালত একটি ফৌজদারি আদালত হিসেবে গণ্য। এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির অনুসরণ করা হবে। বাংলাদেশে পরিবেশবিষয়ক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হয়েছে। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই হয়েছে হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে, সরাসরি পরিবেশ আদালতে নয়। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরিবেশ আদালতের বয়স আজ ১৫ বছর প্রায়। অথচ পরিবেশ আদালতকে তার মূল পরিবেশ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কারণ পরিবেশ আদালতে মামলা হয় না। কেন মামলা হয় না পরিবেশ আদালতে? পরিবেশ আইন ও নীতিমালার ভয়াবহ লঙ্ঘন গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত হচ্ছে চোখের সামনে, সরকারি কর্মকর্তাদের নাকের ডগায়, অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র, বন উজাড় করা হচ্ছে, বসতবাড়ি নির্মাণের উদ্দেশ্যে জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে দিনের পর দিন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিল, পুকুর, খাল, লেকগুলো কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে ভরাট করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাবলে যত্রতত্র মাইক বাজিয়ে রাজনৈতিক সভার প্রচারাভিযান ও রাজনৈতিক সভা করা হয়। মানবাধিকারের ধারণা আজ শুধু মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণমুক্ত পরিবেশপ্রাপ্তির অধিকারটিও। শুধু আজকের নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। এর জন্য কাগুজে আইন নয়, প্রয়োজন আইনের সঠিক বাস্তবায়ন। যেখানেই কলকারখানা সেখানেই ওই কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ নির্গমনের অত্যাবশ্যকতা থাকে। পানি ও বায়ু যাতে বর্জ্য পদার্থ দূষিত করতে না পারে তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। অথচ সরকার কলকারখানা প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েই দায় সারে। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ যে পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য বিপজ্জনক সে বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়।
কোনো বিষয়ের ওপর আইন প্রণয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। আইনের সুষ্ঠু ও সুষম প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নই ওই আইনকে পরিপূর্ণ করে। এ সুষ্ঠু প্রয়োগ সরকার কর্তৃক জোর করে চাপিয়ে দিলেও চলবে না, জনগণের সহনশীলতার সীমায় থাকতে হবে। সচেতন হতে হবে শিক্ষিত সমাজকে। সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারলেই সহনশীল হবে পরিবেশ। 

 

চট্টগ্রাম

[email protected]

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]