প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বুধবার, মে ১, ২০১৯ | |
শ্রমিকের জীবনের ন্যূনতম দাবি পূরণ হয় না। বরং এদিন গাড়ি-কলকারখানা বন্ধ থাকায় অনেকের আয়-রোজগার বন্ধ থাকে। তাদের অনেক কষ্টে দিনটি পার করতে হয়। মে দিবস বাংলাদেশের অনেক শ্রমিকের কাছে এমন ‘প্রহসন’ হয়েই আসে। অথচ বিশ্ব ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণির দাবি ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে দিনটি অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে চলেছে। ইতিহাসের সব যুগেই শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগেও শ্রমিকের অস্তিত্ব ছিল। খ্রিষ্টজন্মের বহু বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ সভ্যতা নির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। মিসরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রেও ছিল শ্রমিক। এদের বলা হতো দাস শ্রমিক। এ শ্রমিকরা ছিল বাধ্য-শ্রমিক। তাদের নিজস্ব কোনো মতামত বা স্বাধীনতা ছিল না। মালিকের ইচ্ছেমতো তাদের চলতে হতো বা কাজ করতে হতো। দাস শ্রমিকদের শ্রমেই নির্মিত হয় মিসরের পিরামিড। হরপ্পা ও মহেনজোদাড়োর নগর নির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এসব সভ্যতা গড়ে তোলার পেছনে শ্রমিকদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। এরপর মানবসভ্যতা যত সামনে এগিয়েছে, শ্রমিকের ভূমিকা তত বেড়েছে। নগর নির্মাণ, বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার, ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরাই সমৃদ্ধি আর প্রগতির চাকাকে সামনে ঠেলে নিয়ে গেছে। ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির জন্ম হয়। ১৬৪০-৫০ সালে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটে। এর আগে ১৫২৪-২৫ সালে অস্থায়ীভাবে জার্মানিতে, ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব ঘটে। শিল্পবিপ্লবের ফলে অর্থাৎ শিল্পকারখানা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া লোক শ্রমিকে পরিণত হয়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসানের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডেই প্রথম বিপ্লব ঘটে। বুর্জোয়ারা এ সংগ্রামে জয়ী হয়ে গোটা ব্যবস্থাকে তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল শত্রু শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ে, ভাগ হয় পরস্পরের সম্মুখীন বিশাল দুটি শ্রেণিতেÑ বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত, মালিকরা প্রথম শ্রেণিভুক্ত এবং শ্রমিকরা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। মে দিবসের উৎপত্তি মূলত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, এটি উৎপাদনমুখী শ্রমিকদের সংগ্রামের ফসল, মে দিবসের উৎপত্তি মূলত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা শ্রমিকের শ্রম শোষণের মাধ্যমে নিজেদের বিত্তের পাহাড় গড়েছে। বিত্তবানদের মুনাফার জন্য শ্রমিকদের যুগের পর যুগ ধরে বেগার খাটতে হয়েছে। ইউরোপে শিল্পবিল্পবের আগে শিল্প শ্রমিকদের কাজের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হতো। কোথাও যদি কোনো শ্রমিক ভুলক্রমে ক্ষীণতম প্রতিবাদ জানাত, তাহলে তার ওপর শুরু হতো অকথ্য নির্যাতন; ছাঁটাই তো অতি তুচ্ছ ব্যাপার মাত্র; প্রহারে প্রহারে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হতো। পরিশেষে অকর্মণ্য করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হতো। এ অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ এবং সংগঠিত হতে থাকে এবং একপর্যায়ে তারা দাবি জানায়Ñ ‘আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়; সপ্তাহে একদিন ছুটি চাই; অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্যহানি অথবা অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন আর নয়।’ আর এভাবেই শ্রমিকদের ন্যায়সংগত দাবি আদায় তথা মানুষের মতো বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়। মে দিবসের উৎপত্তি মূলত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এটি উৎপাদনমুখী শ্রমিকদের সংগ্রামের ফসল। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের বিষয়টি এক দিনেই সামনে আসেনি। প্রায় ১২১ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, ধর্মঘট, শ্রমিকের রক্তের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এ দাবি। সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অপরিমেয় ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। প্রচ- পরিশ্রমের পরও তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। নিয়মিত কাজ নেই। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তারা সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারে না। চিকিৎসাসেবা থেকেও তারা এবং তাদের সন্তানরা বঞ্চিত। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন; তাদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে শ্রমিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ কাজ করে পোশাক শিল্পে। ৪০ লাখের বেশি নারী শ্রমিক এ খাতে কর্মরত। অথচ তারা নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
২৪ এপ্রিল ছিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ষষ্ঠ বার্ষিকী। ২০১৩ সালের এদিন ঢাকার উপকণ্ঠে একটি আটতলা ভবন ধসে পড়েছিল। এতে ১১৩৮ শ্রমিক নিহত এবং ২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হন। এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়। অতীতে দেখা গেছে, অগ্নিকা-সহ নানা দুর্ঘটনায় পোশাক শিল্পে বহু শ্রমিক নিহত ও আহত হয়েছেন। আর এসব দুর্ঘটনার পেছনে মালিক পক্ষের গাফিলতিই মূলত দায়ী ছিল। তবে এখন অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে বলা যায়।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, সেটা হলো শিশুশ্রম। বাংলাদেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখের মতো শিশু কর্মরত রয়েছে। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। শিশুশ্রমের এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষায়। বড় কথা হচ্ছে, শিশু শ্রমিক নির্যাতন। কলকারখানায় যেসব শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত তারা তো ন্যায্য মজুরি পায়ই না, তার ওপর চলে মালিকের নির্যাতন। একজন শিশু শ্রমিককে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মালিক পক্ষ কাজ করায়। এটা হলো বড় ধরনের একটা নির্যাতন। আমার চাই, এবারের মে দিবসে অঙ্গীকার হোকÑ নারী ও শিশুশ্রমিক নির্যাতন বন্ধ করা।
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও
চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |