logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, মঙ্গলবার, মে ৭, ২০১৯
হত্যার হুমকি : অতঃপর?
উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গি এবং জঙ্গি উৎপাদনকারী ও প্রশ্রয়দাতাদের শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হোক। অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি পন্থায় ওই হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধেও কঠোরতম এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা হোক
রণেশ মৈত্র

মনটা ৪ মে শনিবার থেকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। একে তো ‘ফণী’ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক নানা শঙ্কায়, ভোগান্তিতে জনজীবন বিধ্বস্তজনিত উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে হঠাৎ করেই গুরুত্বহীনভাবেই যেন কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালকে হত্যার হুমকির খবর কয়েক সেকেন্ডে অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে প্রচারিত হলেও তা চোখে পড়ে যায়। 
পরদিন সকালে সংবাদপত্র হাতে এলে তাতে দেখলামÑ মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ‘ইসলামের স্বার্থে’ হত্যা ও শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে একটি জঙ্গি সংগঠন। এ বিষয়ে ৪ মে শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেছেন সুলতানা কামাল। ডিজি নং-১০৭১। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সমর্থিত অনলাইন ম্যাগাজিন ‘লোনউলকে’ এ বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়। সুলতানা কামাল ছাড়া আর কাকে কাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে পত্রিকাটিতে তার উল্লেখ না থাকায় প্রগতিশীল কয়েকজন ব্যক্তিত্বের (যারও সুলতানা কামালের মতো শতভাগ অসাম্প্রদায়িক) কথা মনে ভেসে উঠল। তবু যেহেতু তাদের নামের তালিকা পাইনি; তাই অনুমান সঠিক হতেও পারে-নাও হতে পারে। কিন্তু এটি তো দিবালোকের মতো সত্য, ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন বেশকিছু দিন পর নতুন করে দেশের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক নাগরিকদের তাদের ‘হিট লিস্টে’ স্থান দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী তাদের হত্যার হুমকি দিতে শুরু করেছে ‘ইসলামের স্বার্থে’।
বছর কয়েক আগেও তারা ব্লগার বলে পরিচিত অভিজিত রায়সহ বেশ কয়েকজন অনুরূপ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত হত্যাও করেছিল নির্মমভাবে। এ হত্যাগুলোর মন্থর তদন্ত এবং বিচার বা কারও শাস্তি না হওয়ায় ওই সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের মনে নিরাপত্তা বোধ জাগ্রত হয়েছে বলে মনে করি এবং তা থেকেই তারা সাহস পেয়েছে এমন সুপরিচিত বিদগ্ধজনদের হত্যার হুমকি দিতে। 
অবশ্য খবরে বলা হয়েছে, জিডি করার পর থেকেই সুলতানা কামালের নিরাপত্তার জন্য তার বাসায় পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো পুলিশ এ ব্যাপারে আন্তরিক এবং সম্ভাব্য যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত। 
তারপরও উদ্বেগ দূর হয় না, মনের শঙ্কাও হ্রাস পায় না অতীতের ওই ভয়াবহ ঘটনাগুলোর কথা ভেবে।
আমরা জানি, হুমকিপ্রাপ্তরা আজকের বাংলাদেশের সম্পদ, তারা জাতির অহংকার। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত ওই ইসলামিক জঙ্গিরা সে কারণেই তাদের টার্গেট করেছে। ওই তালিকায় আরও অনেকের নাম থাকতে পারে, যাদের আজও বাংলাদেশের বড্ড প্রয়োজন। দেশকে এখনও তাদের দেওয়ার অনেক কিছু আছে। 
শঙ্কা ও উদ্বেগ আরও বাড়ে গোটা পৃথিবীর হাল-হকিকত দেখে। এই তো সেদিন মাত্র নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত ৫০ ধর্মানুরাগী মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, শতাধিককে আহত করা হলো। বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো যে, আমাদের ক্রিকেট দলের অনেকে নামাজ পড়তে ওই মসজিদের কাছে যেতেই অসংখ্য লাশ ও রক্তের বন্যা দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ফিরে আসেন তাদের হোটেলে। কিন্তু ওই আহতদের মধ্য থেকে চিকিৎসারত আরও একজন মুসল্লি মারা গেছেন।
নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপ্রিয়, সভ্য ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এমন মর্মান্তিক ঘটনা যে ঘটতে পারে, এমনটা গোটা বিশ্বে কেউ কল্পনায়ও আনতে পারেনি। বরং গোটা পৃথিবী হয়েছে স্তম্ভিত। 
কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, এমন ভয়াবহ ঘটনা সেখানে ঘটল এবং অসংখ্য নির্দোষ ব্যক্তিকে হারাতে হলো বহু মায়ের, অনেক স্ত্রীর, অনেক প্রেমিকার, অনেক ভাইবোনের আপনজন নিমিষেই হারিয়ে গেলেন। বিশ্ব যাদের হারাল তাদের মধ্যে কয়েকজন নিউজিল্যান্ড অভিবাসী জনাকায়েক বাংলাদেশিও ছিলেন। 
এরপর দুই-তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই ভয়াবহ খবর এলো শ্রীলঙ্কা থেকে। সেখানে তিনটি গির্জায় খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন ইস্টার সানডের প্রার্থনারত কয়েকশ ধর্মানুরাগীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেলেও একই সন্ত্রাসী জঙ্গি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা আরও অনেককে একইভাবে অতর্কিতে হত্যা করল। দেশি-বিদেশি তিন শতাধিক মানুষ নিমিষেই হারিয়ে গেলেন, রক্তের বন্যা বইল কলম্বো নগরীতে, অশ্রুবন্যা বইল সমগ্র পৃথিবীতে। 
কী করল ওই জঙ্গিরা নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায়? উভয় জায়গার ঘটনায় হতাহত হলেন অন্তত হাজার পাঁচেক মানুষÑ ধর্মীয় পরিচয়ে তারা মুসলমান, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ সবাই। কোনো ধর্মাবলম্বী মানুষই রেহাই পাননি। হত্যার অভিযান চালালেন দৃশ্যত নিউজিল্যান্ডে শ্বেতবর্ণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় উগ্রবর্ণ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী এক খ্রিষ্টান। ওই খুনিকে গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হয়েছে। মামলা আজও তদন্তাধীন। দেখা হচ্ছে, খুনি ও চিকিৎসাধীন লোকটি প্রকৃতিস্থ ছিল, নাকি মস্তিষ্ক বিকৃতিতে ভুগছিল। মেডিকেল রিপোর্ট পেলেই দ্রুত পুলিশি তদন্ত শেষ হতে পারবে।
খুনিটা যে শ্বেতবর্ণের মানুষদের প্রাধান্য চেয়েছিল বলে প্রচার হলোÑ তার সেই উদ্দেশ্য কি ৫১ মুসলিমকে (মূলত অভিবাসী) হত্যা ও দেড়শ মুসলিমকে আহত করার ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো? নিউজিল্যান্ডে তো শ্বেতবর্ণেরই প্রাধান্য খ্রিষ্টানদেরও। তা হলে কি হত্যালীলার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে শ্বেত ও খ্রিষ্টান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল বা হতে চলেছে? বিশ্ব কালো মানুষহীন, মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধহীন হয়ে গেল কি?
আবার শোনা যায়, অন্তত আইএস দাবি করে বলেছে যে, তারা তাদের ‘মুসলমান ভাই’দের নিউজিল্যান্ডে হত্যার ‘প্রতিশোধ’ নিতেই শ্রীলঙ্কার ঘটনা ঘটিয়েছে। উভয় দেশের ঘটনার দায়ই আইএস স্বীকার করেছে।
এখানে এ প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক হবে যে, নিউজিল্যান্ডে না হয় একজন খ্রিষ্টান ৫১ মুসলমানকে হত্যা করেছে। সে কারণে খ্রিষ্টান বা সব দেশের খ্রিষ্টানকে দায়ী করা যায় কোন যুক্তিতে। প্রতিশোধ নেওয়া হলো শ্রীলঙ্কার খ্রিষ্টানদের ওপর গির্জায় হামলা চালিয়ে। হতাহত যে খ্রিষ্টানরা ওই গির্জাগুলোতে হলেন তারা কি আদৌ নিউজিল্যান্ডের হত্যালীলার জন্য দায়ী? তা যদি না হন; তবে তাদের হত্যা করার মাধ্যমে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়াটা কি কোনো ধার্মিক তার কল্পনায় আনতে পারে?
আরও লক্ষণীয় যে, শ্রীলঙ্কার মুসলিম জঙ্গিরা যারা আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা যাচ্ছে, তারা তো শুধু গির্জা আক্রমণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেলেও বোমা নিক্ষেপ করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, আহত করেছে। হোটেলে অবস্থানকারী এ মানুষগুলো তো শ্রীলঙ্কার নন, তারা সবাই বিদেশি পর্যটক। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই খ্রিষ্টান। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই ছিলেন পর্যটক হিসেবে, তাহলে অখ্রিষ্টানদের ওই তথাকথিত প্রতিশোধের উসিলায় হতাহত করাটাও কি যুক্তিসংগত? এটা কি ইসলাম ধর্ম অনুমোদন করে?
বস্তুত শ্রীলঙ্কার ঘটনার মাধ্যমে ওই জঙ্গিরা বা আইএসভুক্ত বা বহির্ভূত উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যা করল তার ফলে ওই দেশে সাম্প্রদায়িকতা নির্ঘাত বৃদ্ধি পাবে, মুসলিমরাই মানুষের টার্গেটে পরিণত হবে। এরই মধ্যে পত্রিকা মারফত জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে, তাদের তরুণরা গ্রেপ্তার বা আক্রমণের আশঙ্কায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এ সংকটজনক, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল আইএস নামক জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। ধর্মীয় বিচারে মুসলমানদের ক্ষতি ইসলামের নামে তথাকথিত মুসলমানরাই করল। কী ভয়ংকর অপব্যবহার ধর্মের। 
এভাবে আজ কয়টি বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মের বা বর্ণের নামে হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাগুলো শুধু বেদনাদায়ক নয়, অত্যন্ত গর্হিত ও বর্বর এবং অসভ্য প্রকৃতির। ধর্মের সঙ্গে যেমন এগুলোর সম্পর্ক নেই, তেমনই আবার ধর্মান্ধ উগ্রবাদ সর্বপ্রযতেœ গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ধর্মীয়, বর্ণগত ও লিঙ্গগত কারণে সৃষ্ট বৈষম্য দূরীকরণ অসম্ভব। 
লক্ষণীয়, এ উগ্র ধর্মান্ধরা বাংলাদেশে সুলতানা কামাল ও অন্য কয়েকজন দেশপ্রেমিক উদার গণতন্ত্রীকে টার্গেট করে তাদের ‘ইসলামের স্বার্থে’ হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এ দুষ্কৃতকারীরা আদৌ হুমকি দিচ্ছে না বা দেবেও না যেসব অসৎ ব্যবসায়ী পবিত্র রমজান মাসে পণ্যমূল্য অহেতুক বৃদ্ধি করছে, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে বিদেশে পাচার করছে, যে অসৎ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খেয়ে দিব্যি রাজার হালে দিন কাটাচ্ছে, যারা নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, যারা ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে, যারা বেআইনিভাবে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করে চলেছে, তাদের বিরুদ্ধে। বরং পারলে ওই ঘুষখোর, মুনাফায়ের অসৎ লোকদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সাহায্য নিয়ে বেআইনিভাবে অস্ত্র কিনে তাদের হত্যালীলা পবিত্র ‘ইসলামের স্বার্থে’ চালিয়ে যাচ্ছে। 
এহেন পরিস্থিতিতে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, সুলতানা কামালের বিন্দুমাত্র ক্ষতি যেন সাধিত না হয়, তার নিরাপত্তা বিধান যে ত্রুটিমুক্ত হয়, তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শান্তিপূর্ণভাবে নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে পারেন দ্রুতই তেমন একটা পরিবেশ রচনা করা হোক। সব বুদ্ধিজীবীর, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী সব কবি, সাহিত্যিক ও অন্যান্য বিদগ্ধজনও যেন একইভাবে নির্বিঘেœ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারেন। 
আর ওই উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গি এবং জঙ্গি উৎপাদনকারী ও প্রশ্রয়দাতাদের শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হোক। অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি পন্থায় ওই হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধেও কঠোরতম এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা হোক। হ

 রণেশ মৈত্র
সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত 
সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]