প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, মে ১০, ২০১৯ | |
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানহীন ও ভেজালযুক্ত ৫২টি পণ্যের তদারকির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন হাইকোর্ট। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালকের নিচে নয়Ñ এমন দুজন কর্মকর্তাকে আগামী রোববার হাইকোর্টে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। শুনানিতে রিটের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। শুনানিকালে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্যে ভেজালের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট।
শুনানির শুরুতে রিটকারী আইনজীবী আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি, আপনি (বিচারপতিগণ) ও আমাদের শিশুরা ভেজাল খাদ্যপণ্য গ্রহণ করছে। বিএসটিআই সংবাদ সম্মেলন করে এসব ভেজাল পণ্যের তথ্য তুলে ধরলেও তারা পণ্যগুলো এখনও জব্দ করেনি।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘এসবের মধ্যে কমন পণ্য কী কী রয়েছে? রূপচাঁদা ও তীরের সয়াবিন তেলসহ অনেক নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্য আছে দেখছি! প্রাণ, ফ্রেশের হলুদের গুঁড়াতেও ভেজাল, তাহলে আমরা কোথায় আছি?’ রিটকারী আইনজীবী
বলেন, ‘আমাদের শিশুরাও এসব খাদ্যপণ্য গ্রহণ করছে। আমরা তাহলে কী করবো?’ আদালত বলেন, ‘ভেজাল পণ্য রোধ করা বা জব্দ করার কাজ সরকারের। এগুলো তাদের দেখা উচিত। আমরা সাধারণ মানুষের মামলা দেখব, নাকি এসব মামলা দেখব? ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কোথায়?’ এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান শুনানির জন্য দাঁড়ালে আদালত তার উদ্দেশে বলেন, ‘কী ব্যাপার? প্রতিদিন এসব ভেজাল পণ্য নিয়ে কোর্টে মামলা আসছে। সরকার কী করছে? বিশেষ ক্ষমতা আইনে এসব বিষয়ে সাজার বিধান নেই?’ জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে।’
আদালত বলেন, ‘বিএসটিআইয়ের তালিকায় রূপচাঁদা, তীরের মতো ব্র্যান্ডের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নাম আসছে, বিএসটিআই শুধু শোকজ করেছে। ভেজাল নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে পণ্যগুলো তুলে নেওয়া উচিত ছিল, এটাই নিয়ম। আমরা কি দেশ চালাই? কোর্ট কি দেশ চালায়? এটা সরকারের কাজ। তবুও এসব কীভাবে হয়? অথচ আমরা (আদালত) আদেশ দিই আর আমাদের সেই আদেশের সমালোচনা করা হয়। তাহলে এ মামলায় কাদের তলব করা যায়?’ রিটকারী আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘বিএসটিআই’র মহাপরিচালককে তলব করা যেতে পারে। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ডেপুটি পদস্থ কাউকে তলব করা যেতে পারে।’ আদালত বলেন, ‘বিএসটিআই ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টরের নীচে নয়Ñ এমন পদস্থ কর্মকর্তাদের আসতে বলুন। এভাবে চলা যায় না। এ ব্র্যান্ডগুলো দেশ ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রাণ লাচ্ছা সেমাইতেও ভেজাল। তারা (বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা) কি করছেন? দেশে ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন আমাদের (হাইকোর্টে) কাছে আসতে হবে? সেখানে কেন যাওয়া হয় না? ঠিক আছে, ওই দুই কর্মকর্তাকে তলব করা হোক। আমরা রোববার (১২ মে) মামলাটি আদেশের জন্য রাখছি।’
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি মানহীন ও নিম্নমানের পণ্য জব্দ এবং এসব পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে বৃহস্পতিবার সকালে একটি রিট দায়ের করেন ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) আইন উপদেষ্টা সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান। সম্প্রতি বিএসটিআই কর্তৃক বাজারে এসব পণ্যে ভেজাল ধরা পড়ার পরও তা জব্দ না করা বা সেগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা না নেওয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ৬ মে দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব ও তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে আইনি নোটিশ দেন ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)। নোটিশের পরও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ রিট দায়ের করা হয়। রিটে ওইসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট পণ্যসমূহ কেন জব্দ করা হবে না বা বাজার থেকে কেন প্রত্যাহার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। ২ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনের প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বিএসটিআই সম্প্রতি ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি পণ্য নিম্নমানের ও ভেজাল রয়েছে। পরে এ বিষয়ে গত ৩ ও ৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
৯৬ দুধের ৯৩টিতেই ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান : বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধের ৯৬টির মধ্যে ৯৩টির নমুনাতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে উল্লেখ করে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তবে কোন কোন কোম্পানির দুধে এসব ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে এবং কারা এর সাথে জড়িত তাদের নাম-ঠিকানা সংবলিত তালিকা আগামী ১৫ মের মধ্যে দাখিল করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের বেঞ্চ বুধবার এই নির্দেশ দেন।
দুধ ও দইয়ে ভেজালসংক্রান্ত এ প্রতিবেদন গত সোমবার হাইকোর্টে দাখিল করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজার থেকে সংগৃহীত কাঁচা তরল দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই সিসা ও অ্যান্টিবায়োটিক অনুজীব পাওয়া গেছে। প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনার মধ্যে ১৮টিতেই ভেজাল পাওয়া গেছে। এছাড়া দুধে ও দইয়ে উচ্চমাত্রার বিভিন্ন রাসায়নিক পাওয়া গেছে।
এর আগে এ রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সিসা মেশানো রয়েছে, তা নিরূপণ করে একটি জরিপ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ১৫ দিনের মধ্যে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। একইসঙ্গে দুধে সিসা মিশ্রণকারীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, দুগ্ধজাত খাবারে ভেজাল প্রতিরোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং খাদ্যে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির (মৃত্যুদ-) নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। জবাব দিতে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়। দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে ভেজালের বিষয়ে কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি এসব আদেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি একেএম হাফিজুল আলমের বেঞ্চ।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ১১ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে পুষ্টির অন্যতম প্রধান জোগান হিসেবে বিবেচিত গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যে এবার মিলেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান। ১০ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য প্রকাশ করেছে সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের প্রতিবেদন। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গরুর খোলা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭ দশমিক ৬৬ পর্যন্ত। আফলাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা ০ দশমিক ৫ হলেও পাওয়া গেছে ০ দশমিক ৯৯৬ পর্যন্ত। টেট্রাসাইক্লিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৬৭১ দশমিক ১৩ পর্যন্ত, সিপ্রোফ্লোক্সাসিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৪৮ দশমিক ৩৬ পর্যন্ত। কীটনাশকের মাত্রা ৫ সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৯ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ দশমিক ২০। প্যাকেটজাত দুধের ক্ষেত্রে টেট্রাসাইক্লিনের সহনীয় মাত্রা ১০০ হলেও দেশীয় প্যাকেটজাত দুধে পাওয়া গেছে ১৮৭ দশমিক ৫৮ পর্যন্ত। আমদানি করা প্যাকেটজাত দুধের ক্ষেত্রে এ উপাদানের মাত্রা ৭১৭ দশমিক ৮২ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর আফলাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা ০ দশমিক ৫ হলেও পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৯৩ পর্যন্ত।’
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |