logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, মে ১০, ২০১৯
ভাঙনের সুর ঐক্যফ্রন্টেও
রকীবুল হক

- জোট ছাড়ার হুমকি কাদের সিদ্দিকীর
- পরিস্থিতি সামলানোর চ্যালেঞ্জে বিএনপি

সংসদে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ভাঙন দেখা দেওয়ার পর এবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও ভাঙনের সুর। ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ হুমকি দেন। তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক অসংগতি রয়েছে। এসব অসংগতি আগামী এক মাসের মধ্যে দূর করা সম্ভব না হলে ৮ জুন ঐক্যফ্রন্ট থেকে আমাদের দলকে প্রত্যাহার করে নেব। 

এর আগে ২০ দলীয় জোটে আলোচনা না করে সংসদে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে সোমবার এ জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। এর পরদিন মঙ্গলবার বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে ২৩ মে পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন ২০ দলীয় জোটের আরেক শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। অন্যথায় ২০ দল ছাড়ার হুমকি দেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মাঝে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এমনকি খোদ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মাঝেও এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি জোটের অনেকেই সমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি। 

গেল বছেরর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে এর ফলাফল বর্জন ও নতুন নির্বাচনের দাবি জানায় বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ নির্বাচনে বিজয়ী ঐক্যফ্রন্টের ৮ জন এমপি শপথ নেবেন না এবং সংসদে যোগ দেবেন না বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি জোটের শরিক বিএনপি ও গণফোরাম। কয়েক দফায় দল দুটির সাতজন এমপি শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমে দুই দফায় গণফোরামের দুজন শপথ নিয়ে ফেললে তাদের সমালোচনায় মুখর হন বিএনপি নেতারা। এমনকি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করায় গণফোরাম থেকে দলটির নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে বহিষ্কার এবং মোকাব্বির খানকে শোকজ করা হয়। কিন্তু শপথ নেওয়ার সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে বিএনপির পাঁচজনও যোগ দেন সংসদে। তারপর থেকে বিএনপি জোটের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দেয়।

জোটের শরিকদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই প্রধান শরিক বিএনপি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে পুনর্নির্বাচন দাবি করার নৈতিকভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে জোটের। 

কাদের সিদ্দিকীর সংবাদ সম্মেলন : চলমান পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের বর্ধিত সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন কাদের সিদ্দিকী। এ সময় তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক অসংগতি রয়েছে। এসব অসংগতি আগামী এক মাসের মধ্যে দূর করা সম্ভব না হলে ৮ জুন এই ঐক্যফ্রন্ট থেকে আমাদের দলকে প্রত্যাহার করে নেব। তিনি বলেন, গেল বছর ১৩ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। সেই বছর ৫ নভেম্বরে আমরা ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করেছিলাম। কিন্তু এই জোটে নির্বাচন-পরবর্তী অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন-পরবর্তী কিছু কিছু কাজে মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা সঠিকভাবে চলতে পারেনি। নির্বাচনি সহিংসতায় আহত-নিহতদের পাশে দাঁড়াতে পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল শাহবাগে গণজমায়েতের ঘোষণা দিয়েও করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে জঘন্য নাটক হয়েছে। যা শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন নাটকের নজির নেই। কিন্তু জোট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পরও কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই সাতজন শপথ নিলেন। গণফোরামের সুলতান মনসুর শপথ নিলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু মোকাব্বির খান শপথ নিলে ড. কামাল হোসেন তাকে গেটআউট বলেন। পরে দেখা যায় গণফোরামের বিশেষ সভায় মোকাব্বির খান উপস্থিত। এসব নিয়ে মানুষের মধ্য বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মানুষ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আমরা জবাব দিতে পারি না।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কাদের সিদ্দিকী বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া আলটিমেটাম দেওয়ার আগে জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মাহমুদুর রহমান মান্না, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের জোটের মধ্যকার অসংগতির কথা বলেছি।
ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের যে সাতজন শপথ নিয়েছেন, তাদের নিন্দা জানান কাদের সিদ্দিকী। এ নেতা বলেন, যারা শপথ নিয়েছেন, তারা মীরজাফরের চেয়েও বেশি নিন্দিত হিসেবে বিবেচিত হবেন।
বিএনপির শপথ নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘তথাকথিত’ নির্বাচিতরা শপথ নিলেন, কিন্তু বিএনপি মহাসচিব শপথ থেকে বিরত থাকলেনÑ এসব মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সংবাদ সম্মেলনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদারসহ দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সোমবার আকস্মিকভাবে ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অতিমাত্রায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টমুখী হয়ে গেছে (বিএনপি), ২০ দলীয় জোটের কর্মকা- শুধু সহমত, সংহতি ছাড়া তেমন কিছুই নয়। ‘প্রহসন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন’ এর পর সংসদে যাওয়াটা নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, সংসদে বিএনপি যে যাবে, এটা আমার দল শুধু নয়, জোটের কেউ জানে না। এসব কারণেই আমি জোট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একই ধরনের অভিযোগ তুলে এবং বিএনপিকে ২৩ তারিখের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করার আলটিমেটাম দেয় ২০ দলের আরেক শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
এদিকে বিজেপির জোট ত্যাগের ঘোষণা এবং লেবার পার্টির আল্টিমেটামের ঘটনায় তৎপর হয়ে উঠেছে বিএনপি। বিজেপিকে ফিরিয়ে জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। শিগগিরই ২০ দলের বৈঠক ডাকারও কথা রয়েছে। এরই মধ্যে কাদের সিদ্দিকীর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য রক্ষা করা নিয়ে বিএনপি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
বিএনপির তৎপরতার বিষয়টি স্বীকার করে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে বলেছি। কারণ ঐক্যফ্রন্ট যেসব কাজ করছে তাতে বিএনপি জোট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট যে ব্যর্থ হয়েছে তা কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। এজন্য ঐক্যফ্রন্টকেই উচিত তাদের এ জোট বিলুপ্ত করে দেওয়া। আমাদের বক্তব্যের পর বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা আমাদের সঙ্গে বসেছেন। আমাদের কথা শুনেছেন। তবে ২৩ তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে আমরা ২৪ তারিখে সিদ্ধান্ত জানাব। এদিকে কাদের সিদ্দিকীর ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার হুমকির বিষয়টি নিয়ে জোটটির অন্য শরিকদের মাঝেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। 
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যকে ইতিবাচক দেখছেন জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের কাছে দেওয়া এক প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি রাষ্ট্র যখন চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত, জনগণের মালিকানা যখন রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে অপসারণ করা হয়েছে, শাসনতন্ত্র যখন সরকারের ইচ্ছাধীন তখন বিরোধী দলের কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার নৈতিক কর্তব্যবোধে জাগ্রত হয়েই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঐক্যফ্রন্টের অসংগতি নিরসনের তাগিদ দিয়েছেন যা খুবই ইতিবাচক এবং ভবিষ্যৎ আন্দোলন-সংগ্রাম-গণজাগরণের ভিত্তি সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মিডিয়া সমন্বয়ক লতিফুল বারী হামিম বলেন, কাদের সিদ্দিকী অনেক সিনিয়র নেতা। তার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তাই তিনি আলটিমেটাম দিতেই পারেন। তবে বিরোধীদলগুলোর ভেতরে অনেক বিষয়ে সমঝোতা থাকতে হয়।
বিএনপিকে তৃতীয় জোট গঠনের পরামর্শ ন্যাপের : বিএনপিকে তৃতীয় জোট গঠনের পরামর্শ দিয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী)। বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্সকালভার্ট রোডে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপিকে এ পরামর্শ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই, ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বামসহ অন্য দলগুলো নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে তৃতীয় জোট গঠন করা। যার নাম হবে ‘বৃহত্তর ঐক্যজোট’। এই জোটের নেতৃত্বে থাকবে বিএনপি। 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]