logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, মে ১৭, ২০১৯
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে জাকাত ব্যবস্থাপনা
ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে যে পরিমাণ অর্থ শুধু ব্যাংকগুলোতে সঞ্চিত অবস্থায় আছে তা থেকে যদি যথাযথভাবে আদায় ও বণ্টন করা সম্ভব হতো তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে জাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা জাকাত হিসেবে আদায় করা সম্ভব। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, জাকাতের ফলে ধনী-দরিদ্রের আয়ের পার্থক্য ৯ থেকে ৬.৫ গুণ কমে যায়। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের যথাযথ আদায় এবং সুষম বণ্টন খুবই প্রয়োজন

জাকাত ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম একটি। (বোখারি : ৪৫১৫)। এ বিধানটি ইসলামের অন্যান্য বিধানের তুলনায় নানা দিক দিয়ে ভিন্ন। এটি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় ধর্মীয় বিধান পালনের পাশাপাশি ব্যক্তির নিজ জীবনের কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অন্যান্য মানুষের জীবনের জন্য কল্যাণকর একটি বিধান। এর মাধ্যমে জাগতিক যে মূল উদ্দেশ্যটি হাসিল হয় তা হলো ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সমাজ বিনির্মাণ। কারণ, জাকাত ধনী মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে গরিবদের মাঝে বণ্টন করা হয়। কিন্তু জাকাত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত কম হওয়ার কারণে শরিয়তের এ বিধানের মৌলিক উদ্দেশ্য (মাকাসিদ আশ-শরিয়া) অর্জিত হচ্ছে না। সুতরাং এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য অপরিহার্য। এ প্রবন্ধে সেসবের কিছু আলোচনা স্থান পেয়েছে। 
বিভিন্ন ধরনের জাকাত 
জাকাত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার প্রাথমিক দিক হলো সোনা, রুপা ও গচ্ছিত/সঞ্চিত অর্থের জাকাতই আমদের একমাত্র আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। জাকাত বলতে শুধু এগুলোকেই বুঝি। এর বাইরে জাকাতের পরিধি আরও বিশদ তা আমাদের জানা নেই। যেমন : 
১. সোনা, রুপা ও সঞ্চিত অর্থ-সম্পত্তির জাকাত
এটিই আমাদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত জাকাত ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত। ৭.৫ তোলা সোনা অথবা ৫২.৫ তোলা রুপা কিংবা সেই সমমূল্যের অর্থ যদি কারও মালিকানায় পূর্ণ এক বছর গচ্ছিত হিসেবে থাকে তাহলে তার ৪০ ভাগের একভাগ বা শতকারা ২.৫ ভাগ শরিয়তের নির্ধারিত ৮টি খাতে বণ্টন করা ওই ব্যক্তির ওপর ফরজ। 
২. ফসলের জাকাত ‘উশর’ (এক দশমাংশ) 
সবচেয়ে উপেক্ষিত জাকাত ব্যবস্থা হলো ‘উশর’ বা ফসলের জাকাত। এটিকে ‘উশর’ বলার কারণ হলো প্রাকৃতিক উপায়ে খরচবিহীন কোনো ফসলের নির্ধারিত পরিমাণ (৫ ওসাক হয় যা প্রায় ২৭ মণ) উৎপাদন হলে তা থেকে দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত বণ্টনের খাতগুলোতে দিতে হয়। এটি ফরজ। কিন্তু উৎপাদনে যদি খরচ হয় যেমন সেচ দেওয়া, চাষ করা, ওষুধ দেওয়া, বীজ বপন করা ইত্যদি তাহলে উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত বণ্টনের খাতে ব্যয় করতে হবে। 
জাকাতুল ফিতর 
রমজানের রোজার ভুল-ত্রুটি মর্জনার জন্য যে পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে কারও ওপর জাকাত ফরজ হয় সে পরিমাণ সম্পত্তি যদি ঈদুল ফিতরের দিন সকালে থাকে তাহলে তার অধীন সবার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট অর্থ জাকাতের খাতগুলোতে দেওয়া ওয়াজিব। সেখানে ব্যয়ের পরিমাণটা ব্যক্তি জীবনধারণের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। সেখানে ৬০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে, দুঃখজনক হলো, সর্বনিম্ন পরিমাণ ৬০ টাকার বেশি জাকাতুল ফিতর দেওয়ার মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। 
ধনী-গরিবের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে জাকাত কীভাবে কাজ করে? 
প্রথমত: সোনা, রুপা এবং সঞ্চিত অর্থের জাকাতের ক্ষেত্রে সমাজের সুবিধাভোগীদের আধিক্যতা গুরুত্ব পাবে। (ইউসূফ আল-কারদাভি, ফিকহুজ জাকাত)। সেখানে সর্বনিম্নœ নিসাবের পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি থাকলেই তাকে জাকাত আদায় করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যসীমারেখার কথা চিন্তা করে রুপার দামকেই প্রাধান্য দিয়ে কার ওপর জাকাত ফরজ তা ধরলে জাকাত প্রদানকারীর সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি বেশি সংখ্যক গরিব উপকৃত হবে। 
দ্বিতীয়ত: ফসলের জাকাত উপেক্ষা করার কারণে এর সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হই। আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি পণ্যের যথাযথ জাকাত আদায় করতে পারলে জাকাত সুবিধাভোগীদের সংখ্যাধিক্যতা বেড়ে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থার প্রবর্তন করা সম্ভব। 
তৃতীয়ত: জাকাত আদায় ও বণ্টনের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আমরা যেভাবে জাকাত আদায় করি যেমন জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি বিতরণ তা জাকাতের নামে জাকাত ব্যবস্থাপনাকে উপহাস, উপেক্ষা করা বৈ কিছুই নয়। এসব আমাদের শরিয়তের উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত করে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে দুটি কাজ করতে হবে : ১. জাকাত আদায় করতে হবে সমষ্টিগতভাবে। এককভাবে জাকাত আদায় করলে অর্থের পরিমাণ স্বল্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা সত্যিকার অর্থে দরিদ্রতা দূরীকরণে সহায়ক নাও হতে পারে। ২. জাকাত বণ্টনের সময় মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি টেকসই এমন কিছু করার দরকার যাতে সত্যিকার অর্থে দরিদ্রতা থেকে ওই ব্যক্তি এবং তার পরিবার মুক্তি পেতে পারে। যেমন হতে পারে কাউকে একটা ভ্যান বা রিকশা কিনে দেওয়া, ছোট চায়ের স্টল করে দেওয়া ইত্যাদি। 
চতুর্থত: ব্যক্তি পর্যায়ে জাকাত আদায় ও বণ্টনের চেয়ে বরং রাষ্ট্র কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামষ্টিক উপায়ে হলে সত্যিকার সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে নগদ সাহায্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের কাজে জাকাতের অর্থ কার্যকরী উপয়ে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। 
পঞ্চমত: রাষ্ট্র কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অনুপস্থিতিতে গ্রাম-গঞ্জের মানুষ যদি একেত্রে মিলে উদ্যোগ গ্রহণ করে সেটিও ফলপ্রসূ ও কার্যকরী হতে পারে। 
ষষ্ঠত: জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে কর্মক্ষম কিন্তু কর্মহীন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করা কিংবা প্রয়োজনে মূলধন দিয়ে ব্যবসার সুযোগ করলে সে এবং তার অধীনরাও উপকৃত হবে এবং অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে সমাজ ব্যবস্থা মুক্তি পাবে। 
পরিশেষে বলব, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে যে পরিমাণ অর্থ শুধু ব্যাংকগুলোতে সঞ্চিত অবস্থায় আছে তা থেকে যদি যথাযথভাবে আদায় ও বণ্টন করা সম্ভব হতো তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে জাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা জাকাত হিসেবে আদায় করা সম্ভব। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, জাকাতের ফলে ধনী-দরিদ্রের আয়ের পার্থক্য ৯ থেকে ৬.৫ গুণ কমে যায়। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের যথাযথ আদায় এবং সুষম বণ্টন খুবই প্রয়োজন। 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]