প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, মে ১৯, ২০১৯ | |
আমরা সামাজিক জীব। সমাজ নিয়েই আমাদের বসবাস। এ সমাজ ব্যক্তিকে নিয়েই গঠিত। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোনো একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না। ব্যক্তির ওপর সমাজ বিশেষভাবে নির্ভরশীল। ব্যক্তিচরিত্র সুগঠিত হলে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, আর এ ব্যক্তিচরিত্র কলুষযুক্ত হলে তার দুষ্প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা হয় বিঘিœত।
আবার ব্যক্তিচরিত্র যখন সমাজে কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে, তখন তার প্রতিটি আচরণ অত্যন্ত সংযত হওয়া চাই। তার সামান্য অসংযত আচরণও সমাজকে স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত করে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সমাজে এখন অসংযত, লোভী, স্বার্থান্ধ ব্যক্তি চরিত্রেরই ভিড়। আর এ সুবাদে আমরা নিত্যনতুন কেলেঙ্কারি দেখতে-শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব ব্যাপার যদি শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তা হলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তি সমাজের বিশেষ অংশ; তাই তার কুপ্রভাবে সমাজজীবন বিপর্যস্ত হয় পদে পদে। সম্প্রতি মা কর্তৃক চাচার সঙ্গে অবৈধ ও অসামাজিক কাজে বাধা প্রদান করায় স্কুলছাত্রী হত্যা ও নির্লজ্জ উচ্ছৃঙ্খলতায় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, অগঠিত ব্যক্তিচরিত্র সমাজকে কতটুকু বিব্রত করতে পারে। বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। উচ্ছৃঙ্খল ভবিষ্যতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ নিবন্ধনের অবতারণা।
আজ আমাদের সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। কিন্তু এর কারণ কী, তা আমাদের ভাবার সময় নেই। আমরা সবাই এখন আধুনিক হতে ভীষণ ব্যস্ত। এর মধ্যেও আজকাল আমাদের অভিভাবকদের সন্তানকে সর্ববিষয়ে পারদর্শী করার প্রবণতাটাও খুব বেশি বেড়ে গেছে। অভিপ্রায়টা মন্দ নয়; কিন্তু এত কিছুর ফাঁকে আসল বিষয় যে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। এ আসল জিনিসটি হলো চরিত্র গঠন। চরিত্রই হলো জীবনের ভিত্তি। ধনী অথবা জ্ঞানী যদি নৈতিক মূল্যবোধশূন্য হন; তবে তিনি ঘৃণার যোগ্য। তাই প্রাচীন ঋষি-মুনি থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের মনীষীরা সবাই জাতির উন্নতির ভিত্তি হিসেবে চরিত্র গঠনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষক আলী আহসানের নির্দেশÑ ‘প্রথমে চরিত্র গঠন কর, এটিই তোমার প্রথম কর্তব্য।’ আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে তার অভিমত, ‘আজকাল শিক্ষা পদ্ধতি মনুষ্যত্ব গড়ে তোলে না। এট শুধু গড়া জিনিস ভেঙে দিতে জানে। ন্যায়-বিজ্ঞান কতকগুলো মুখস্থ করলেই শিক্ষা হয় না।’ অধ্যাপক আবুল ফজলের মতে, ‘ছাত্রজীবনে প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য চরিত্র গঠন। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক চরিত্র গঠন চাই। তা না হলে কিছুই হবে না।’ ঋষি অরন্দির মতে, ‘নৈতিক মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে যদি বৌদ্ধিক শিক্ষার বিস্তার করা হয়, তা সমাজের পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকারক।’ জার্মান দার্শনিক হার্বাটের মতে, ‘চরিত্র বা নীতিবিজ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য।’ কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়, শিল্পবিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সমাজে যথেষ্ট অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। তার মূল কারণ হলো, নৈতিক শিক্ষা আজ অবহেলিত। ফলে সমাজ জীবন বিপর্যস্ত। কারণ শিশুই তো সমাজের ভবিষ্যৎ পরিচালক। যে শিশুটি বড় হয়ে সমাজের হাল ধরবে, সমাজকে পরিচালনা করবে, সে যদি সুচরিত্রের অধিকারী না হয়; তবে তার দ্বারা সমাজের উপকার কীভাবে আশা করা যায়? সে যে ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন; তার অগঠিত চরিত্রের কুপ্রভাব সমাজের ওপর পড়বেই। তাই তো আজকাল শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, ব্যবসাক্ষেত্রে, প্রশাসনিক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রে সুচরিত্রের অভাবে বিপর্যস্ত। বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে তো আর কথাই নেই, রাজনীতির কথা শুনলেই ভদ্র সমাজ আঁতকে ওঠে। কিন্তু কেন? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমাদের কাছেই।
আগেই বলেছি, সমাজ ব্যক্তিকে নিয়েই গঠিত। কিন্তু এ ব্যক্তি কোথায় তৈরি হয়? নিশ্চয়ই পরিবারে? পারিবারিক পরিবেশেই তো একটা শিশু বড় হয়। তাই শিশুর চরিত্র গঠনে পরিবারের অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মৌখিক উপদেশে মূল্যবোধ শেখানো যায় না। বাস্তবে আচরণের মাধ্যমেই তা শেখানো সম্ভব। তাই দেখা যায়, যেসব পরিবারে ধর্মীয় পবিত্র পরিবেশ বিদ্যমান সেসব পরিবারের শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই নীতিপরায়ণ হয়, তার চরিত্রে নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে। এ প্রসঙ্গে একটি অপ্রিয় সত্য কথা অত্যন্ত দঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, আজকাল বেশিরভাগ আধুনিক পরিবারেই শিশুরা অভিভাবকের কাছ থেকে স্বেচ্ছাচারিতা, মিথ্যাচার, কর্তব্যে অবহেলা, বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন, অবাধ্যতা ইত্যাদি দেখেই বড় হয়। ফলস্বরূপ, পরিণত বয়সে তার চরিত্রে এসব ভয়ংকর দোষ প্রতিফলিত হতে থাকে। তখন তার দ্বারা পরিবার বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এসবই তো আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। প্রাচীনকালে তাই শৈশবে গুরুগৃহে পাঠিয়ে সংযম, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, কঠোরতা শিক্ষার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তোলার রীতি ছিল। আজকাল আমরা বেশি আধুনিক হতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারছি। তাই তো আমাদের এ দুরবস্থা। এখন প্রায় অভিভাবককেই অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে অনুযোগ করতে শোনা যায়, ‘এত কষ্ট করে, এত টাকা খরচ করে তাকে ছেলেমেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু সে অমানুষ হলো।’ আসলে অভিভাবকরা ভুলে যান, টাকায় মানুষ তৈরি করা যায় না।
পরিশেষে বলতে চাই, এই যে নৈতিক অধঃপতন সমাজে দৃশ্যমান, এর জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কারা? অভিভাবকরাই নন কি? যে সন্তানটি আপনার এবং সমাজের ভবিষ্যৎ, তার নৈতিক চরিত্র গঠনে আপনি কতটুকু যতœবান? ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া কি নৈতিক চরিত্র গঠন সম্ভব? না কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সমাজের আগামীদিনের অভিভাবক মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর, উচ্ছৃঙ্খল হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে আপনি সদা সতর্ক আছেন কি? আপনার আদরের সন্তানটি যাতে সমাজের সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র হতে পারে, সেজন্য যে বিশেষ গুণগুলো প্রয়োজন, সেই সৎগুণগুলো তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন কি? আপনার সন্তানের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ দৃষ্টিকটু না হয়ে যাতে সভ্যতার অনুকূল হয়, সে বিষয়ে আপনি কি সতর্ক? আপনি কি আপনার আদরের সন্তানকে সংযম, শৃঙ্খলা, সত্যবাদিতা, সদাচার, শালীনতা ইত্যাদি আচরণের মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছেন? ভাবুন, অভিভাবকরা ভাবুন, গভীরভাবে ভাবুন। কারণ আমরা সবাই সমাজেরই অংশ। কেউই সমাজকে এড়িয়ে চলতে পারব না। সমাজকে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকেরই। তাই আসুন মহামানব পৃথিবীর সব ধর্ম ও জাতির শ্রদ্ধার পাত্র আমাদের নবী করিম (সা.) এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণে এক সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য এবার উচ্ছৃঙ্খলতার মূলোৎপাটনে বদ্ধপরিকর হই, সুচরিত্রের ভবিষ্যৎ অভিভাবক তৈরি করি। বিজ্ঞানের ভাষায়Ñ ‘গার্হস্থ্যাশ্রমই মানুষ গঠনের সূতিকাগার।’ ইংরেজি প্রবাদÑ ‘ঈযধৎরঃু নবমরহং ধঃ যড়সব’ এগুলো যেন আমরা ভুলে না যাই। যদি ভুলে যাই, তাহলে আমাদের প্রচুর মাশুল দিতে হবে আজ না হয় কাল। হ
ষ আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |