logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, মে ১৯, ২০১৯
প্রসঙ্গ : দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণা
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যদিও অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় না। এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ দাখিল করে। দুদক নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও সরকারের সদিচ্ছায় দুদকের প্রতি এখনও মানুষের আস্থা রয়েছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করতে পারবেÑ এ ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৮ এর আংশিক তুলে ধরা হলো। ‘সরকারি দপ্তরের প্রতিটি দপ্তরে পদে পদে দুর্নীতি হচ্ছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য খাত, ভূমি ব্যবস্থাপনা, হিসাবরক্ষণ অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু জায়গায় পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। থানায় সেবা বাড়াতে ওসিদের পদে নন-ক্যাডার কর্মকর্তার পরিবর্তে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুলিশ) ক্যাডারের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ অথবা অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়নে সুপারিশ করেছে দুদক। সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে দুর্নীতি প্রতিরোধে একাধিক কর্ম কমিশন সৃষ্টি করে এর মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে দুদক। এভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২০টি সুপারিশ করেছে দুদক। দুদকের ভাষ্যÑ সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী দায়িত্ব, তা জানে না অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া পদ্ধতিগত ত্রুটি, সঠিক গাইড লাইন না থাকার কারণে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত সেবা পায় না সেবাগ্রহীতারা। এসব কারণসহ বিভিন্ন কারণে হচ্ছে দুর্নীতি। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৮) এসব সুপারিশ করা হয়। গত সোমবার সুপারিশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও সেবায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোতে দৈনন্দিন কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও কাজে গতিশীলতা আনার পরামর্শ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ভূমি ব্যবস্থাপনা, পাসপোর্ট প্রদান সহজীকরণ, স্বাস্থ্য, আয়কর, হিসাবরক্ষণ অফিস, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, সরকারি নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, মন্ত্রণালয়ের কার্য উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জন হয়রানির সম্ভাব্য উৎসগুলো চিহ্নিত করেছে। এসব দুর্নীতি-অনিয়ম বা হয়রানি দূর করতে ১২০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এসব খাতের মধ্যে নিয়োগ দুর্নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, ‘সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থার নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়ম কিংবা স্বজনপ্রীতির কথা সবাই জানেন। নিয়োগ দুর্নীতিকে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাই নিয়োগ দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে দুদক।’ এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে শেখ হাসিনা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই স্ফীত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে। আমরা মনে করি দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী করে আধুনিকায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা করবে সরকার। দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু। রাষ্ট্রকে আগে চিহ্নিত করতে হবে কোথায়, কোন খাতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। দেখা যায়, সরকারি সেবাধর্মী খাতে বেশি দুর্নীতি হয়। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির কথা জানা গেল। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সেবাধর্মী খাতগুলোতে মানুষের চলাচল বেশি থাকে। তাই দুর্নীতিও বেশি হয়। এক বছরের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। সেবা খাতে বছরে দুর্নীতি হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ঘুষ-দুর্নীতি হয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি বেশি হয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দুর্নীতি সহনশীল মাত্রায় আনা সম্ভব। যদিও গোটা বিশ্বই এ সমস্যার মোকাবিলা করছে। হিসাব মতে, প্রতি বছর সারাবিশ্বে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়। এর মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি হয় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও দুর্নীতিবাজরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যদিও অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় না। এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ দাখিল করে। দুদক নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও সরকারের সদিচ্ছায় দুদকের প্রতি এখনও মানুষের আস্থা রয়েছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করতে পারবেÑ এ ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে। তবে ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দুদকের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্ত করতে হবে। নতুবা এ আইনের অপব্যবহার হতে পারে। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক দল চাই, দুর্নীতিমুক্ত নেতা চাই, দুর্নীতিমুক্ত সরকার চাই, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই। সরকারি-আধাসরকারি অফিস থেকে দুর্নীতি দূর করতে পারলে জাতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাবে। আইনের দোহাই দিয়ে অথবা গ্রেপ্তার করে সরকারি অফিস থেকে সাময়িকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এই তো গেল দুর্নীতির কথা। সুশাসন নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সুশীল সমাজ আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সুশাসন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাক্সিক্ষত ও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পেতে হলে শাসনের পাশাপাশি কাউন্সিলের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও তাদের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, আমাদের জনসংখ্যার একটা অংশ, বিশেষ করে ধনিকশ্রেণি, ব্যক্তি ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের কথা চিন্তায় নেয় না। এদের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যয় করা হয় না। নিরাপত্তাজনিত কারণে এরা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে থাকেন। এদের প্রভাবে ব্যাংকিং সেক্টর আজ অস্থিতিশীল। অনেক সময় পুঁজি সাইফোন্ড হয়ে যায়। আমাদের পুঁজিপতিরা এ দেশের যে অর্থ উপার্জন করেন, তা যদি মানুষের স্বার্থে ব্যয় করেন, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর এমন সংকটের মুখে পড়ত না। বঙ্গবন্ধু কিছুসংখ্যক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রয়োজনে বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল তার মূল দর্শন। বাংলাদেশে আজ যে ধনিকশ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, দলবল নির্বিশেষে তারা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। এদের কারণে উৎপাদিত ফসলের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। শেখ হাসিনার প্রকট দৃষ্টি গরিব মানুষের দিকে। কিন্তু শ্রেণি স্বার্থে সচেতন ধনিকশ্রেণি সৃষ্ট সম্পদ এককভাবে উপভোগ করতে চায়। গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণের কথা তারা মোটেই ভাবে না। এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে, এদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শোষক শ্রেণির বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্নীতি আজ উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে, উন্নয়ন তৎপরতার গতি থমকে যাবে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দেশ ও জাতির চরম শত্রু দুর্নীতিবাজরা। আইনের প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিরোধী দল নয়, সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম
বীর মুক্তিযোদ্ধা
সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]