logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, সোমবার, মে ২০, ২০১৯
ফুঁসে উঠছে রাজশাহীর সচেতন মহল
নদী দখল করে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি!
রাজশাহী ব্যুরো

রাজশাহীতে পদ্মা নদী দখল করে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনে শ্রীরামপুর এলাকায় এরই মধ্যে নদীর বেশকিছু অংশ দখলে রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এখন ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।

তবে নদী দখল করে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে এরই মধ্যে ফুঁসে উঠেছে রাজশাহীর সচেতন মহল। তারা নদী দখল না করার দাবিতে মানববন্ধনও করেছে। রোববার সকালে রাজশাহী কারাগারের সামনের সড়কে ‘রাজশাহীবাসী’ ও ‘স্বাধীনতা চর্চা কেন্দ্র’ এ কর্মসূচি পালন করে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যে জায়গাটি কারা কর্তৃপক্ষ দখলে নিয়েছেম সেখানে এখনও প্রতি বর্ষায় পানি আসে। আবার বর্ষা পার হলে চর জেগে ওঠে। চর জেগে উঠলে স্থানীয়রা আগে সেখানে ফসলের চাষ করতেন। এছাড়া দৃষ্টিনন্দন এ এলাকায় দর্শনার্থীরা সময় নদী দখল করে কারা

কাটাতেন। তবে এখন আর সেখানে কাউকে নামতে দেওয়া হয় না। দইুজন কারারক্ষী সব সময় এলাকায় পাহারায় থাকেন।
শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর ধারে গিয়ে দেখা যায়, শহররক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর কারা কর্তৃপক্ষ একাডেমির নামে ছয়টি সাইনবোর্ড বসিয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে লেখা আছে ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প অনুমোদনক্রমে কারা একাডেমির জন্য নির্ধারিত স্থান’। কোনোটিতে লেখা রয়েছে, ‘সংরক্ষিত এলাকা, সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’। আবার কোনোটিতে রয়েছে জমির বিবরণ।
বাঁধের নিচে দক্ষিণে নদীর দিকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশের খুঁটি পুঁতে কারাগারের জমির সীমানা নির্ধারণ করে রাখা আছে। খুঁটিগুলোয় লাল, হলুদ পতাকা টানানো। সীমানার মাঝ বরাবর নদীর মধ্যে একটি টিনশেড নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে দুজন কারারক্ষী পাহারায় নিয়োজিত আছেন। তাদের একজন জানান, তারা জমি পাহারা দিচ্ছেন। দুজন করে রক্ষী ২০১৭ সাল থেকে ৬ ঘণ্টা করে পাহারা দিচ্ছেন। বর্ষায় যখন এলাকাটি প্লাবিত হয়, তখন তারা বাঁধের ওপর উঠে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে রাজশাহীতে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার আগে দেশে কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীদের প্রশিক্ষণের কোনো জায়গা ছিল না। রাজশাহীতে জেলখানার ভেতরেই পুরোনো একতলা ভবনে এর কার্যক্রম চলে আসছে। তিনটি টিনশেডে পুরুষ ও নারী প্রশিক্ষণার্থীরা থাকেন এবং তাদের ক্লাস করার জন্য ব্যবহার করা হতো আরেকটি টিনশেড ভবন।
একাডেমিতে শারীরিক, তত্ত্বীয়, অস্ত্র ও অস্ত্রহীন যুদ্ধের নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে জেল সুপারদের ছয়টি ব্যাচ, ডেপুটি জেলারদের ১০টি ব্যাচ এবং পুরুষ ও নারী কারারক্ষীদের ৪২টি ব্যাচের বিভিন্ন মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানের অভাবে এ কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করে কর্তৃপক্ষ। এরপর বাংলাদেশের একমাত্র এ কারা প্রশিক্ষণ একাডেমিটি ২০১৪ সালের আগস্টে সরকারি অনুমোদন লাভ করে।
পরে ২০১৫ সালের জুনে একনেকের সভায় একাডেমির ভৌত অবকাঠামোগুলো তৈরির জন্য ৭৩ কোটি ৪২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্প অনুযায়ী রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জমিতেই একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের মোট জমির পরিমাণ ৬৫ দশমিক ৪০৭০ একর। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৮১৯ একরের ওপর রয়েছে কারাগার।
বাকি ৪৬ দশমিক ৫২৫১ একর জমির মধ্যে একাডেমির জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩৭ দশমিক ১৩৩৫ একর। এর মধ্যে ৪ একর জমি বলা হচ্ছে পদ্মা নদীর ওই চর। আর এ চার একর ছাড়াও নদীর ভেতর থেকে একাডেমির জন্য আরও ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে চাইছে কর্তৃপক্ষ। অফিসিয়াল কিছু নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কারা কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয় থেকে পদ্মা নদীর জমি চেয়ে আবেদন করেছে এবং সেই জমিকে ‘নতুন জেগে ওঠা চর’ হিসেবে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কারা অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক আলতাব হোসেন বলেন, অন্য এলাকায় পছন্দ মতো জায়গা না পাওয়ার কারণে নদীর জায়গাটি নির্বাচন করতে হয়েছে। তিনি জানান, তারা চেয়েছিলেন কারা একাডেমিটি যেন নদীর পাশেই কোনো স্থানে হয়, যেন প্রশিক্ষণের উপযোগী পরিবেশ বজায় থাকে। চরের জমিটি পেলে তারা সেখানে শরীরচর্চা, খেলাধুলাসহ নানান প্রশিক্ষণের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলবেন। তবে নদীর জমিতে কাজ করতে হলে তাদের নদী ভরাট ও নদী শাসনের মতো কর্মসূচিও হাতে নিতে হবে, যাতে বন্যায় এলাকাটি প্লাবিত না হয়।
আলতাব হোসেন বলেন, প্রকল্পটির কাজ শুরুর সময়েই পদ্মা নদীর ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়, তবে পূর্ণাঙ্গ আবেদনটি করা হয় গেল বছর। তার দাবি, নদীর ৪ একর জমি কারাগারের নামে থাকার রেকর্ড রয়েছে। তারা আরও ১০০ একর জমি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এ বিষয়ে অগ্রগতির বিষয়ে তেমন কিছু জানাতে চাননি কারা অধিদপ্তরের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষ পদ্মা নদীর ভেতর ৪ একর জমির মালিকানা দাবি করলেও রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলমগীর কবির জানিয়েছেন, রিভিশনাল সার্ভে অনুযায়ী, পদ্মা নদীর শ্রীরামপুর এলাকায় প্রায় ২ দশমিক ৮ একর জমি কারা কর্তৃপক্ষের নামে পাওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশ ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন-১৯৯০ অনুযায়ী নদী বা সমুদ্র গর্ভ থেকে কোনো চর জেগে উঠলে তার মালিক হবে সরকার। ফলে আইন অনুযায়ী জমিটির মালিক সরকারই হবে।
এদিকে একাডেমির জন্য কারা কর্তৃপক্ষ জমি দখলের চেষ্টা চালালেও ২০১৬ সালেই এর ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয় গণপূর্ত বিভাগ। নদীর যে জায়গাটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার উত্তরে শহররক্ষা বাঁধ, বাঁধের সঙ্গেই একটি পাকা সড়ক এবং সড়কের পাশ ঘেঁষেই ১২টি প্যাকেজে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। একাডেমির প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ব্লক, প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাস ভবন ও মেস নির্মাণের কাজ এ বছরেই শেষ হওয়ার কথা। বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা এবং বৃক্ষ রোপণের কাজ টেন্ডার আহ্বানের পর্যায়ে রয়েছে। আবার কিছু গাছ কেটেও ফেলা হয়েছে।
জানা গেছে, কারাগারের মোট জমিতে বহু বছর ধরে রোপিত গাছের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। এর মধ্যে একাডেমি নির্মাণের জন্য প্রায় ৮০০ গাছ কেটে ফেলার প্রয়োজন হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৬১টি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বন বিভাগ গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণ করেছিল ১১ লাখ টাকা। তবে টেন্ডার আহ্বান করার পর চারজন সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ৫৬১টি গাছ ১৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। গাছগুলোর মধ্যে শত বছরের ঐতিহ্যের গাছ আছে অনেকগুলো। এসব গাছে আছে শত শত পাখির বাসা। সম্প্রতি গাছগুলো কাটা শুরু করে ঠিকাদার। প্রায় ৬৬টি গাছ কাটার পর স্থানীয়রা বিক্ষোভ শুরু করলে গেল ২৯ এপ্রিল কর্তৃপক্ষ গাছ কাটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় যে, পুরোনো এবং ফলদায়ক গাছগুলো আর কাটা হবে না।
এখন পদ্মার জমি সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবিতেও আন্দোলন শুরু হলো। রোববার কারাগারের সামনে আয়োজিত ওই মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, নদীকে নদীর মতোই চলতে দিতে হবে। নদীর বুকে পিলার গাঁড়তে দেওয়া হবে না। কারা উপমহাপরিদর্শকের উদ্দেশে বক্তারা বলেন, স্থাপনা গড়ে উঠলে অবসরের পর কারারক্ষীরা আপনাকেই নদীর পাড়ে যেতে দেবে না। পরবর্তী প্রজন্মকে আপনি কী জবাব দেবেন? তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ওই মানববন্ধন কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন স্বাধীনতা চর্চা কেন্দ্রের আহ্বায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান রাজ, রাজশাহীবাসীর সদস্য সচিব নাজমুল হোসেন রাজু, কৃষিবিদ রেজাউল করিম মহব্বত প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহীবাসীর আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু। মানববন্ধন পরিচালনায় ছিলেন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভিপি রায়হান উদ্দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের বলেন, সরকার চাইলে নদীর জমি বন্দোবস্ত দিতে পারে। তবে পদ্মা নদীর জমি কারা কর্তৃপক্ষ বন্দোবস্ত চেয়েছে কি না, তা তার জানা নেই। জেলা প্রশাসক বলেন, আমার কাছে এ রকম আবেদন নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আসেননি। তিনি জানান, কতটুকু জমি কারা কর্তৃপক্ষের নামে আছে, আর কতটুকু তারা দখল করে রেখেছেন তা কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। এ বিষয়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]