
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, মে ২৬, ২০১৯ | |
জাকাতের মাধ্যমে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় সম্ভব। এ তহবিল ব্যবহার করে বঞ্চিত মানুষের সচ্ছলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর এ অর্থায়ন নিশ্চিত হলে কমবে বৈষম্য, বেগবান হবে দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি। দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতই কার্যকর উত্তম ব্যবস্থা। জাকাত সমাজে ন্যায্যতা বাড়ায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে উত্তোলনকৃত জাকাতের অর্থের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা দরকার।
হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় ও টেকসই উন্নয়নে জাকাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এমন তাগিদ উঠে আসে। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট আলহাজ কাজী রফিকুল আলম। এছাড়া ধারণা বক্তব্য তুলে ধরেন জাতীয় রাজস্ব
বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক কাজী আলী রেজার সঞ্চালনায় গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের সিইও ড. মোহাম্মাদ আইয়ুব মিয়া, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক ড. এম এহছানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ, বঙ্গভবন জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হজরত মাওলানা সাইফুল কবির, গাউসুল আজম জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা নুরুল হক, সিলেকশন টেকনোলজির সিইও মো. রায়হান উদ্দিন খান, হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মাদ লকিয়ত উল্লাহ, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউশন অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক মুফতি শেখ মোহাম্মাদ উসমান গণি, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সাধারণ সম্পাদক ড. এসএম খলিলুর রহমান, হজ ফাইন্যান্সের ডিএমডি মসিউদ্দৌলা প্রমুখ।
গোলটেবিল বৈঠকে জাকাতের সম্ভাবনা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা, সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনায় সম্পৃক্ততা, সঠিক ব্যক্তি নির্ধারণ, মনিটরিংসহ নানাদিক গুরুত্ব পায়। আলোচকরা বলেন, দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতই কার্যকর উত্তম ব্যবস্থা। জাকাত সমাজে ন্যায্যতা বাড়ায়। তবে ইসলামের এ ফরজ ইবাদতের সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার।
জাকাতের অর্থ ব্যবহারে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং খাত চিহ্নিত করতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে জাকাত ফান্ড ব্যবহার করার কারণে যথার্থ সুফল মিলছে না। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম এবং বেসরকারি খাতের অর্থায়ন উৎস হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে এ দুই মাধ্যম। বলা হয়, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জাকাত ফান্ডে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই উৎসাহ দেখায় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে জাকাতের অর্থ দেওয়ার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করালে, সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব। আর জাকাত দিলে কর মওকুফ করার ক্ষেত্রেও পরামর্শ আসে।
ধারণা বক্তব্যে ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রমজানে যে কোনো দানের ফজিলত ৭০ গুণ। জাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। সম্পদের বৈষম্য দূর করতেই জাকাতে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এটার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা দরকার। এটি হলে আদায়টা নিশ্চিত হবে। না হলে কেউ দেবে, কেউ দেবে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের জাকাত ফান্ডে দেওয়া জাকাত সঠিকভাবে বিতরণ হচ্ছে কি না সেটা নিয়ে আস্থার অভাব রয়েছে। এজন্য বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। আইনের ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে যে পরিমাণ এফডিআর আছে সেখান থেকে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা জাকাত দেওয়া সম্ভব। জাকাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে চেষ্টা করতে হবে। এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় ঋণ দেওয়া হয়। এতে সুদ আছে, ফলে যে ব্যক্তি নেয় সে ওই টাকার মালিক হতে পারে না। কিন্তু জাকাত যাকে দিচ্ছি সে তার মালিক। এজন্য কীভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, সবার উদ্যোগে নিয়মে এনে প্রকল্প করা যায় সেটা বের করতে হবে।
ড. মোহাম্মাদ আইয়ুব মিয়া বলেন, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কৌশলে এখনও জাকাত সেভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জাকাত আদায় ও বিতরণে বিশাল ব্যবস্থাপনা দরকার। ইতিহাসে দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতের ভূমিকা বিদ্যমান। কিন্তু মুসলিমরা এখন সেটা ভুলে গেছে। এখন আমরা চ্যারিটি করি। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে আইন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় জাকাত বাধ্য করা হয়। আর কিছু রাষ্ট্র আছে যেখানে বেসরকারিভাবে জাকাত দেওয়া হয়। এদেশেও আইন আছে কিন্তু জাকাত বাধ্যতামূলক নয়।
তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালে আন্তর্জাতিকভাবে জাকাত সম্মেলন হবে। জাকাত প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ১০টি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে আইনগত বৈধতা, দক্ষ জনবল, শরিয়া বোর্ড, সরকারি অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কৌশল, জনগণের আস্থা ও স্বচ্ছতা, সরকারের উন্নয়ন কৌশলে সমন্বয়, সুপারভিশন ও মনিটরিং উল্লেখযোগ্য। জাকাতের দ্বারা দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো আর কোনো ব্যবস্থাপনা নেই বলেও জানান তিনি।
ড. এম এহছানুর রহমান বলেন, সরকারের জাকাত বোর্ড সীমিত পরিসরে চলছে। সরকারিভাবে জাকাত আদায়ে সীমাবদ্ধতা আছে। বিতরণ কাঠামোতে গাইডলাইন প্রয়োজন। ট্যাক্স দিতে সরকার যেমন বাধ্য করে এটাও রাষ্ট্রীয়ভাবে করা উচিত। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২১ সালে শুরু হবে। জাতীয়ভাবে সরকারি উন্নয়ন কাঠামোতে জাকাত সম্পৃক্ত করতে হবে। জাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) ১ নম্বর লক্ষ্যই হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ। আর ১০ নম্বর হলো আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণÑ এ দুটো জাকাত দ্বারা সম্ভব। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ১১ শতাংশ বা দুই কোটি মানুষ হতদরিদ্র। সঠিকভাবে জাকাত আদায় হলে প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষকে ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে তাদের উন্নয়ন সম্ভব।
ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ বলেন, দেশে জাকাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। জাকাত অনেকে দেয় কিন্তু সেটার সঠিক হিসাব দিতে পারে না। মানুষকে জাকাতমুখী করতে দেশে তিন লাখ মসজিদের ইমামদের উচিত সঠিক বিষয়টি জানানো। সরকারের জাকাত বোর্ডকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
হজরত মাওলানা সাইফুল কবির বলেন, জাকাতের সঠিক উত্তোলন ও পরিকল্পনামাফিক বিতরণ দরকার, যাতে দারিদ্র্য বিমোচন হয়। যিনি জাকাত দেবেন তিনি তার সম্পদকে পবিত্র করবেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যা আসছে তা ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হয়। এটা প্রশ্নবিদ্ধ। জাকাতের অর্থ জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বণ্টনের ব্যবস্থা করা দরকার। জাকাতের কাপড় নিতে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়। সেক্ষেত্রে জাকাত হালাল হবে না। এ বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে।
গাউসুল আজম জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা নুরুল হক বলেন, প্রত্যেক মসজিদে জাকাতের ফরজ বিষয়টি বোঝানো হলে এর মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন হবে। মো. রায়হান উদ্দিন খান বলেন, মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি করা জাকাতের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য।
মোহাম্মাদ লকিয়ত উল্লাহ বলেন, ১১টি খাতে আহ্ছানিয়া মিশন জাকাত ব্যয় করে। মানুষ জাকাত দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে কিন্তু উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান পায় না। যাদের জাকাত দেওয়া হচ্ছে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে কি না সেটা মনিটরিং করতে হবে। জাকাতের যথাযথ দৃশ্যমান ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আদায় আরও বাড়বে।
মুফতি শেখ মোহাম্মাদ উসমান গণি বলেন, ‘জাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। এর মাধ্যমে যেন দারিদ্র্যবিমোচন হয়। আর জাকাত গ্রহণে উপযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা যেন লাভবান না হয়।
ড. এসএম খলিলুর রহমান বলেন, ২০০৫ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন অফিসিয়ালি জাকাতের টাকা উত্তোলন শুরু করে। ওই বছর ২২ লাখ ১৪ হাজার ৩২০ টাকা জাকাত আদায় ও বিতরণ হয়। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের জাকাত ফান্ড নীতিমালা আছে। শরিয়া কাউন্সিলে ছয়জন সদস্য আছেন। প্রতি বছর মনিটরিং করা হয়। এখানকার জাকাত ফান্ড থেকে ৭ শতাংশ ম্যানেজমেন্ট কস্ট নেওয়ার বিধান থাকলেও সেটা নেওয়া হয় না। ২০১৫ সাল থেকে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন কাজ শুরু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৯৯ ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়েছে। বর্তমানে মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
মসিউদ্দৌলা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে জাকাত রিমাইন্ডার ডিক্লেরেশন করা যেতে পারে। এতে করে ব্যাংকাররা গ্রাহককে টাকা জমা হওয়ার পর জাকাতের উপযুক্ত হলে রিমাইন্ডার দিতে পারবেন।
কাজী আলী রেজা বলেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের উদাহরণ আছে।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট আলহাজ কাজী রফিকুল আলম সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |