প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, মে ২৬, ২০১৯ | |
মাঠপর্যায়ে ভূমি প্রশাসনে কর্মরত মোহরার, প্রসেস সার্ভার, চেইনম্যান এবং এমএলএসএসদের ২০ শতাংশ পদোন্নতি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪ সালের নিয়োগ বিধিতে ওই চার পদে ২০ শতাংশ পদোন্নতির বিধান থাকলেও ২০১৮ সালে প্রণীত নিয়োগ বিধিতে পদোন্নতির বিধান রাখা হয়নি। বিষয়টি জানতে পেরে ওই পদগুলোতে কর্মরত কর্মচারীরা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, অতিরিক্ত সচিব (বিধি) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং ভারপ্রাপ্ত ভূমি সচিবকে পত্র দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন আবেদনকারীরা। উপায়ান্তর না দেখে তারা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করে প্রতিকারের আবেদন করেছেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৩৫ বছর পর কর্মচারী নিয়োগবিধি হালনাগাদ করা হচ্ছে। একমাত্র যুগোপযোগী নিয়োগবিধির অভাবে গেল ৩১ বছরে মন্ত্রণালয়ের অধীন মাঠ প্রশাসনে জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি কাউকে স্বাভাবিক পদোন্নতি প্রদানও। যে বা যারা পদোন্নতি নিয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায় নিয়ে পদোন্নতি নিতে হয়েছে। অথচ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, ভারপ্রাপ্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং সহকারী সচিবদের কোনো দায় ছিল না। তারা বিগত ৩৫ বছরেও কেন নিয়োগবিধি তৈরি করতে পারেননি; এজন্য তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতেও হয়নি।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতির বিধান না রাখার বিষয়ে নিয়োগবিধি প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা উপসচিব (মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা তথা তহশিলদারদের পদ আপগ্রেড হওয়ার সময় অর্থ বিভাগ থেকে বলে দেওয়া হয়েছেÑ ওই পদে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে। পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা যাবে না। তিনি বলেন,
মেধাবীদের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতেই হয়তো অর্থবিভাগ এ শর্ত দিয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং এম এ পাস করা ছেলেমেয়েরা এখন পিয়ন-দারোয়ানের চাকরি করেন। এ নিয়োগবিধি তৈরি করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। মতামত গ্রহণ করা হয়েছে অর্থ বিভাগের। ৩৫ বছর পর ভূমি মন্ত্রণালয় যে স্বেচ্ছায় নতুন নিয়োগবিধি প্রণয়ন করেছে, তা কিন্তু নয়। উচ্চ আদালত ২০১০ সালের রায়ে বলেছেন, সামরিক শাসনামলের সব ফরমান বাতিল করতে হবে। উচ্চ আদালতের ওই সিদ্ধান্তের আলোকে মন্ত্রিসভায়ও একই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সামরিক সরকারের আমলের ফরমানগুলোকে বাতিল করে নতুন আইন-বিধি প্রণয়ন করা হবে। উচ্চ আদালত ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের ঠেলায় পড়ে তারা নতুন করে নিয়োগবিধি প্রণয়নের কাজে হাত দেন। রায়ের পরপরই যে ভূমি মন্ত্রণালয় এ কাজে হাত দিয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং উচ্চ আদালতের রায় ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে প্রায় ৯ বছর। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, যদি সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত না থাকত, তাহলে আরও ১০০ বছরেও ভূমি মন্ত্রণালয় কর্মচারি নিয়োগবিধি প্রণয়ন না করলে তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। তারা জানান, এর আগে প্রধান বিচারপতি কেএম হাছানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০/২০০০ নং মামলার রায়েও নতুন করে জনবল নিয়োগের জন্য নিয়োগবিধি হালনাগাদ করার রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেই চলছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আদালতের রায় কিংবা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত থোড়াই কেয়ার করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের ভেতরের-বাইরের, অর্থাৎ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ (ভূরেজ) অধিদপ্তর, ভূমি আপিল বোর্ড, ভূমি সংস্কার বোর্ডসহ যে কোনো কর্মচারী যখন কোনো সমস্যায় পড়েন তখন তারা হাইকোর্টে রিট করে দেন। এখন মামলার ভারে ন্যুয়ে পড়ার অবস্থা মন্ত্রণালয়টির। বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতি বঞ্চিত করার পাঁয়তারা : সাল ১৯৮৪। তখন রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সে সময় তৈরি করা নিয়োগবিধিতে ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে, অর্থাৎ ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস এবং ডিসি অফিসের এলএ শাখায় কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ পদোন্নতির বিধান রাখা হয়। সেই থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে যারা এসএসসি পাস, তারা নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে আসছেন। ৩৫ বছর পর এখন দেশে শিক্ষিতের হার বহুগুণ বেড়েছে। এখন সরকারি অফিসের পিয়ন, দারোয়ানের চাকরি করেনÑএমন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আছেন, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং এম এ পাস করেছেন। বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এমএলএসএস তথা অফিস সহায়ক পদে চাকরি করেনÑ এমন কমপক্ষে দুই ডজন ছেলেমেয়ে আছেন, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং এম এ পাস করেছেন, যাদের রেজাল্ট দেখে অনেক অফিসারও থ-বনে যান। একইভাবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর সংস্থায় যারা ছোট পদে, অর্থাৎ ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডে চাকরি করছেন, তাদের অনেকেই অনার্স ও এম এ পাস। স্বাভাবিকভাবে ভূমি অফিসের ক্ষেত্রেও তাই। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা সরকারি ছোট চাকরিতে আসবে, তাদের উৎসাহিত করার জন্য কর্মজীবনে একটি পদোন্নতির বিধান থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তা না করে ভূমি মন্ত্রণালয় উল্টো তাদের ২০ শতাংশ পদোন্নতি কেটে দিয়ে শতভাগ সরাসরি নিয়োগের বিধান করেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে তাদের জন্য ৫০ ভাগ পদোন্নতির বিধান রাখা উচিত ছিল। কারণ এখন শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এসব পদে চাকরি করছেন।
নিয়োগবিধি ঘেঁটে দেখা গেল, ১৯৮৪ সালের নিয়োগবিধিতে এমএলএসএস থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে ২০ শতাংশ কর্মচারী সহকারী তহশিলদার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০১৮ সালের নিয়োগবিধিতে পদোন্নতি বিধান তুলে দিয়ে সহকারী তহশিলদার পদে শতভাগ সরাসরি নিয়োগের বিধান করা কার্যসহকারী পদেও পদোন্নতির কোনো বিধান রাখা হয়নি। এ পদ আগে জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামোতে ছিল না। এবার নতুন করে সংযুক্ত করা হলেও ওই পদে পদোন্নতির কোনো বিধান করা হয়নি। ড্রাফটম্যান সহকারী পদে নাজির কাম ক্যাশিয়ার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকদের মধ্যে থেকে পদোন্নতির বিধান করা হয়েছে নতুন নিয়োগ বিধিতে। এ পদও আগের জনবল কাঠামোতে ছিল না। কার্যসহকারী পদটিও জনবল কাঠামোতে নতুন সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু পদোন্নতির কোনো বিধান রাখা হয়নি। নাজির কাম ক্যাশিয়ার পদটি আগের নিয়োগ বিধিতে ছিল না। এখন নতুন সংযোজন করা হলেও পদোন্নতির বিধান না রেখে সরাসরি নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। শুধু অফিস সহায়ক, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে ৫০ শতাংশ পদোন্নতির বিধান রাখা হয়েছে। বাস্তবে উপজেলা ভূমি অফিসে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের একটিমাত্র পদ। পক্ষান্তরে একটি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক, উপজেলা ভূমি অফিসে চেইনম্যানের একটি করে পদ রয়েছে। অর্থাৎ একটি পদে পদোন্নতির জন্য একজন কর্মচারীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। শুরু হবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। পকেট ভারি হবে অসাধু কর্তাব্যক্তিদের।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |