logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, সোমবার, মে ২৭, ২০১৯
ইসলামে শান্তির পয়গাম
আহমদ আবদুল্লাহ

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের 

ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৮)

বিশ্বের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট নীতির কারণে বিভিন্ন মহল থেকে আজ বিশ্বের সর্বত্র ইসলামকে বৈষম্য ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এসব মিডিয়া সংবাদ, প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ছায়াছবি, সক্ষাৎকার প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে অহরহ এ ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে যে, ইসলাম ও শান্তি এমন দুটি পরস্পরবিরোধী বস্তু, যে দুইয়ের মধ্যে একত্রে সমাবেশ কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলামী শিক্ষাকে মোটামুটিভাবে অধ্যয়ন করলেও উপরোক্ত ধারণা যে অমূলক ও ভিত্তিহীন তা যে কোনো বিবেকসম্পন্ন লোকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা মোটেই কঠিন নয়। প্রকৃত পক্ষে ইসলাম যেভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা, ঐক্য ও সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠতার বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে, বিশ্বের কোনো ধর্ম, সভ্যতা বা সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে তা আজও সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা এককথায় বলতে গেলে ইসলামের নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এর আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্যই ছিল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। এই অর্থে তিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত তথা আশীর্বাদস্বরূপ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। 

সত্যিকার অর্থে ইসলাম হচ্ছে আগাগোড়া একটি আশীর্বাদ। সন্ত্রাস, জুলুম, অত্যাচার, বর্বরতা ইত্যাদি অসামাজিক, অমানবিক অনাচার ও কদাচারের সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। ইসলাম একজন অমুসলিমের কাছে এই দাবি করে যে, সে যেন স্থির, ধীরতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ইসলাম অধ্যয়ন করে এবং গভীরভাবে তার ক্রিয়াকর্মগুলোও প্রত্যক্ষ করে আর একজন মুসলিমকে নির্দেশ দেয়, সে যেন অমুসলিম বিশেষ করে আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের হিকমত ও বিজ্ঞতার সঙ্গে উপদেশ প্রদান করে, তাদের সামনে ইসলামি শিক্ষার সৌন্দর্যগুলো তুলে ধরে। তাদের সঙ্গে অযথা তর্ক-বিতর্ক করবে না, আর এমন কোনো আচরণও করবে না যার ফলে তাদের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করলেও তা করতে হবে সৌজন্যের সঙ্গে, যুক্তি ও প্রমাণের সঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সঙ্গে করতে পারো, যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং বল, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো এক আল্লাহ। আমরা তারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৬)। 

এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের অনুসারীদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা প্রতিপদে স্থিরতা, ধীরতা, বিজ্ঞতা ভদ্রতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তারা যেন রূঢ় কথার জবাব নম্র কথায় এবং রাগের জবাব সহিষ্ণুতায়, অভদ্রতার জবাব ভদ্রতায় এবং হৈচৈ ও চেঁচামেচির জবাব নম্রতা ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রদান করে। হ্যাঁ, যদি কেউ বিজ্ঞতাপূর্ণ প্রমাণভিত্তিক কথার জবাব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে প্রদান করে তাহলে তার সঙ্গে তারই মানানসই ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ অবস্থায়ও এটা শ্রেয় যে, যথাসম্ভব নম্রতা ও ভদ্রতা যেন হাতছাড়া না হয়। পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সঙ্গেও অনুরূপ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত (বিজ্ঞতা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা (বিতর্ক) কর সদ্ভাবে।’ (সূরা নাহল : ১২৫)।

পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন জায়গায় প্রিয় নবী (সা.) এর মাধ্যমে মুসলমানকে এই শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে যে, তারা যেন সবাইকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, ভালো দ্বারা খারাপকে প্রতিরোধ করে, সব সময় যেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় এবং কোনো অবস্থায়ই যেন শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারকে হাতছাড়া না করে। তাদের প্রধান চিন্তা যেন এমন হয়, কীভাবে আমি আমার সম্বোধিত ব্যক্তির অন্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করব এবং কীভাবে তাকে দেখাতে সক্ষম হবো সরল ও সঠিক পথ। এভাবে যদি তা (মুসলমানের) দলিল-প্রমাণ অন্যদের (অমুসলিমদের) বোধগম্য হয়, তার আচার-আচরণ সভ্যতাপূর্ণ হয়, ইসলাম তথা একটি সরল সঠিক দ্বীনকে বোঝানোরই লক্ষ্যেই তার কথোপকথন হয় তাহলে অবশ্যই সে সম্বোধিত ব্যক্তির (অমুসলিমদের) চিন্তাধারার সংশোধন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সক্ষম হবে। বিনয় ব্যবহার ও বিনম্র আচরণের প্রতিফল সব সময়ই সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে থাকে, তা পবিত্র কোরআনের নিম্নের আয়াত দ্বারা অতি সহজেই বোঝা যায়। ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সূরা হা-মিম : ৩৪)।

ইসলাম এতই শান্তিপ্রিয় ধর্ম যে, মুসলমানকে যুদ্ধাবস্থায়ও জুলুম ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণ থেকে নিরস্ত রাখে, নির্দোষ মানুষকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে, যে কারও সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শত্রুরা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবে। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনফাল ৬১)। যারা দুশমনের পেশকৃত সন্ধির আহ্বানে সাড়া দেয়, তারা মূলত ওদের মানবিক ও চারিত্রিক স্পৃহাকে জাগ্রত ও প্রস্ফুটিত করে তোলে এবং নিজেদের ওদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে। এ জন্যই এ জাতীয় লোকদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৮)।

যেসব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ষড়যন্ত্র করে না এবং তাদের কোনোরূপ কষ্ট দেয় না, ইসলাম তাদের সঙ্গে দয়া, মায়া, হৃদ্যতা, সহানুভূতি, শুভাকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছামূলক আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাদের সঙ্গে তাদেরই কর্মদোষের কারণে ভালো ব্যবহার করা যাবে না সত্য, তবে কোনো অবস্থায়ই বাড়াবাড়িমূলক আচরণ করা যাবে না। বরং বাহ্যিকভাবে হলেও তাদের সঙ্গে যথাসম্ভব সভ্য আচরণ করতে হবে। আর কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা না থাকলে তাদের সঙ্গে সব রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতেও আপত্তির কিছুই নেই। আমাদের প্রিয়নবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন এবং পরবর্তী যুগের মুসলিম মনীষীদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা পরিদৃষ্ট হয় যেগুলোতে অমুসলিমদের সঙ্গে দয়ার্দ্র ব্যবহার ও বিনয় নম্র আচরণের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর নবী (সা.) যেভাবে অমুসলিমদের সঙ্গে সর্বাবস্থায় মানবতাসুলভ দয়ার্দ্র আচরণ করেছেন তার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে বিরল। 

 

লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা বাইতুন নূর, ঢাকা 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]