logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, মঙ্গলবার, মে ২৮, ২০১৯
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সমাপ্তি ঘটাচ্ছেন মোদি?
আলোকিত ডেস্ক

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে, একজন সাধারণ চা বিক্রেতা থেকে দলের শীর্ষ পদে আরোহণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গল্পটি সাধারণ মানুষকে কতটা আন্দোলিত করেছে।

মানুষ এরকম সাধারণ জীবনের অসাধারণ গল্প পছন্দ করেন। আর নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে মানুষ সে রকম একটি গল্পের খোরাকই 

পেয়েছেন। মোদির নিজের ভাষ্য মতেÑ শৈশব থেকে দারিদ্র্যতার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। জীবন ধারণের জন্য চা বিক্রি করেছেন। তার জীবনের গল্পটাও ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মতই, যারা দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপন করেন, কখনও কখনও সম্পদশালীদের প্রভাবে নিজেদের প্রাপ্যটুকুও পান না।
ভারতের সাধারণ মানুষ মোদিকে নিজেদের একজন হিসেবে দেখে। তাকে এমন একজন হিসেবে দেখে যিনি কি না, দরিদ্রদের পক্ষে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে লড়াই করবেন।
মি. মোদির মতে, তিনি প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ধনী সম্প্রদায়, বিশেষ করে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার দলের প্রচারণার সময় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীকে কটাক্ষ করে ‘শাহজাদা’ বা রাজপুত্র বলেও সম্বোধন করেছেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে নেহেরু গান্ধী পরিবারÑ যারা ওই সময় থেকে অধিকাংশ সময়ই ভারত শাসন করে এসেছে। তাদের প্রতি এ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল তার। কিন্তু এখন উল্টে গেছে পাশার দান।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে ‘রাজপুত্র’ রাহুল গান্ধীর দল কংগ্রেসের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর মি. গান্ধীর ভবিষ্যৎই এখন শঙ্কার মুখে। আরও বেশি চিন্তার বিষয় হলোÑ রাহুল গান্ধী তার দলের শক্ত ঘাঁটি আমেথির আসনেও বিজেপির প্রার্থী স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের অনেকের জন্যই এবারের নির্বাচনের ফল ততটা খারাপ ছিল না। ত্রিবেদি সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ডেটা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবার থেকে এসেছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নির্বাচনে যেই হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।
তবে মি. গান্ধীসহ রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবার থেকে আসা আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থীর পরাজয়ে এ প্রশ্ন উঠেছে যেÑ ভারতের রাজনীতিতে কী পরিবারতন্ত্রের প্রভাব কমে যাচ্ছে? ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী দলের আখিলেশ যাদব, এবারের নির্বাচনে বিজেপির জয়রথ থামাতে বহুজন সমাজ পার্টির প্রধান মায়াবতীর সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। মি. যাদব তার নিজের আসনে জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু পুরো রাজ্যের হিসাবে বিজেপির সামনে দাঁড়াতে পারেননি। উত্তর প্রদেশের মোট ৮০টি আসনের ৬২টিতেই বিজেপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। মি. যাদবের স্ত্রী ডিম্পল যাদব কনৌজ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং হেরেছেন। মি. যাদব ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং উত্তর প্রদেশের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়াম সিং যাদবের ছেলে। দুই বছর আগে দলের নেতৃত্ব নিয়ে বাবা মুলায়াম সিং যাদবের সঙ্গে আখিলেশ যাদব দ্বন্দ্বে জড়ানোর পর বর্তমানে বাবা ও ছেলে পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন।
কিন্তু এবারের নির্বাচনের আগে মুলায়াম সিং যাদব তার ছেলের হয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন, এমনকি র?্যালিও আয়োজন করেছেন। কিন্তু ওই কৌশল ধোপে টেকেনি, কারণ বিজেপি যাদব পরিবারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টিকেই তাদের বিরুদ্ধে প্রধান ইস্যু হিসেবে কাজে লাগিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল। একই পরিবারের প্রতিনিধিকে বারবার ক্ষমতায় না আনার জন্য উত্তর প্রদেশের জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালিয়েছিল বিজেপি। যাদব পরিবারকে তারা উত্তর প্রদেশের গান্ধী পরিবার হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিল।
নির্বাচনের ফল বলে, বিজেপির ওই কৌশল ভালোই কাজে লেগেছে। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি শুধু যে ভারতে সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বহুকাল ধরে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিক ধারাই বিরাজমান রয়েছে। 
জর্জ বুশ সিনিয়র এবং তার ছেলে জর্জ বুশ জুনিয়র দুজনই যেমন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তেমনি কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র্যুডোর বাবা পিয়েরে ট্র্যুডোও কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু সমর্থকদের কাছে কীভাবে বার্তা উপস্থাপন করতে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধহস্ত মি. মোদিÑ যেটি নির্বাচনে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কন্ট্রোলরিস্কস কন্সালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক প্রত্যুষ রাও বলেন, রাজনীতিতে সঠিক বার্তা প্রদান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
অভিজাত পরিবারতন্ত্র দ্বারা তৈরি একটি রাজনৈতিক প্রথা ভাঙতে একজন সাধারণ মানুষের গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন মোদি এবং অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে সেই সাধারণ মানুষের গল্পটিকে মানুষের মনে গেঁথেছেন, বলেন মি. রাও। মি. রাও আরও বলেন, ভারতের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত পরিবারের পরিচয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে ভারতে রাজনৈতিক পটভূমির ভিত্তি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটারের সম্পর্ক ছিল রাজা ও প্রজার সম্পর্কের মতো। কিন্তু এখন একজন প্রার্থীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অনেকটাই লেনদেনভিত্তিক।
আমেথিতে মি. গান্ধীর পরাজয় থেকে আমরা যেটা বুঝতে পারি, তা হলোÑ এখন আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার পক্ষে তার আসনকে সামন্ততান্ত্রিক অঞ্চল হিসেবে মনে করার আর অবকাশ নেই বলেও জানান মি. রাও।
উত্তর প্রদেশের পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারেও লজ্জাজনকভাবে হেরেছে সেখানকার রাজনীতির প্রতিপত্তিশালী পরিবারের প্রার্থীরা। সাবেক মন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব দুর্নীতির দায়ে দ-িত হলে তার ছেলে তেজস্বী যাদব তাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নিয়ন্ত্রণ নেন। তবে তেজস্বী যাদবের প্রথম পছন্দ কিন্তু রাজনীতি ছিল না। তিনি পেশাদার ক্রিকেটে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে রাজ্য দলের হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেন। পরে আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের স্কোয়াডেও জায়গা পান। ওই সময় সমালোচকদের অনেকেই বলেছিল, তিনি রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটিয়েই দলে জায়গা পেয়েছেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যখন খুব একটা সাফল্য পেলেন না, তখন তেজস্বী তার বাবার মতো রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। পরিহাসের বিষয় হলোÑ লালু প্রসাদ যাদবের নিজের গল্পটাও নরেন্দ্র মোদির মতোই। মি. যাদবের শুরুটাও খুবই সাধারণ ছিল এবং তিনিও অতি সাধারণ গ্রাম্য জীবনযাপন করার জন্য খ্যাত ছিলেন। বিহারের ভোটাররা তাকে নিজেদের একজন মনে করেছিল বলেই তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার ছেলে তেজস্বীর ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই এ রকম নয়। ফলাফল, বিহারের ৪০টি আসনের একটিতেও তাদের দল আরজেডি জয়লাভ করতে পারেনি। অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু গল্পটা খুব একটা আলাদা নয়। মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়রের তৎকালীন রাজ পরিবার থেকে আসা জ্যোতিরাদিত্য শিন্দিয়া তার আসন হারিয়েছেন।
তার বাবা ছিলেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের একজন এবং গুনা আসনটিকে তাদের পরিবারের রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাজস্থানের ঘেলত পরিবার এবং মুম্বাইয়ের দেওরা পরিবারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। দক্ষিণ ভারতে হেরেছেন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারাস্বামীর ছেলে নিখিল কুমারাস্বামী।
সাবেক এবং বর্তমান মন্ত্রীদের ছেলেরা নির্বাচনে হারছেনÑ এমনটা ভারতের রাজনীতিতে খুব একটা দেখা যায় না। নতুন এ ধারা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদি রাজনীতির যে ব্র্যান্ড নিয়ে এসেছেন; ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক, বাকপটু এবং জাতীয়তাবাদীÑ সেই ধারাই ভারতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]