
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, মে ৩০, ২০১৯ | |
ভারতের লোকসভা (জাতীয়) নির্বাচনে এবারও কংগ্রেসের পরাজয় নিয়ে নানা কথাই শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে ভারতের বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানাভাবেই বিশ্লেষণ করছেন। কেউ বলছেন, বিজেপির হিন্দুত্ববাদ আবার জয়ী হওয়ার কারণ, কেউবা বলছেন, নরেদ্র মোদির দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাই তাকে আবারও ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর কংগ্রেসের বিষয়ে একটি কথাই বেশি জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, তাহলো ‘যোগ্য নেতৃত্বের সংকট’। আসলেই কি তাই? ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের যাত্রা শুরু হয় সেই ১৮৪৪ সালে। আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে। এ ১৭৫ বছরে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৪ সালে) থেকে আজকের রাহুল গান্ধী (বর্তমানে আছেন)। এ সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি বা মূল নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑ উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নওরোজি, তয়েবজি, ইয়ুল, ওয়েডেরবার্ন, মেহতা, চারলাপ্পা, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ানি, নায়ার, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, চন্দবরকর, লালমোহন ঘোষ, এইচ কটন, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রাসবিহারী ঘোষ, মালব্য, মুধোলকর, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, অম্বিকাচরণ মজুমদার, মতিলাল নেহেরু লালা লাজপত রায়, সি. বিজয়রাঘবাচারিয়ার, চিত্তরঞ্জন দাশ, এম. আলি, আবুল কালাম আজাদ, গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, মালব্য নেলি সেনগুপ্ত, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদ, জীবৎরাম কৃপালনি, সীতারামাইয়া, ইউএন ধেবর, ইন্দিরা গান্ধী, নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, কে কামরাজ, এস নিজলিঙ্গাপ্পা, জগজীবন রাম, শঙ্কর দয়াল শর্মা, দেবকান্ত বড়–য়া, রাজীব গান্ধী, পিভি নরসিংহ রাও, সীতারাম কেশরী, সোনিয়া গান্ধী ও বর্তমান রাহুল গান্ধী (উল্লেখ্য, সব নাম এখানে আসেনি বা পাওয়া যায়নি)। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, আবার এ কংগ্রেসই দীর্ঘ সময় ভারত শাসন করেছে। কংগ্রেস নেতৃত্বে সংকটে পড়ে মূলত ইন্দিরার মৃত্যুর পর থেকে। কংগ্রেসের দক্ষ নেতৃত্ব আর ভারত শাসনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে গান্ধী পরিবার। আর সেই গান্ধি পরিবারেই নেতৃত্বের সংকট। প্রথমেই বলতে হয় নেহেরুর কথা। ১৯৩৬ সালে নেহেরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এর লক্ষ্মৌ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সে সম্মেলনে ভবিষ্যৎ ভারতের জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করার পক্ষে নেহেরু বক্তব্য রাখেন। ১৯৩৮ সালে কমলা নেহেরু মৃত্যু মুখে পতিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের ভাইসরয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই ভারতের পক্ষে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে সব কংগ্রেসি জনপ্রতিনিধি তাদের পদ থেকে ইস্তফা দেন। যুদ্ধের পর ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে, এ আশায় নেহেরু ব্রিটিশদের সমর্থন দেন। অন্যদিকে সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষ শক্তিকে সমর্থন দেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করলে গান্ধী ও বল্লবভাই প্যাটেল আন্দোলনের ডাক দেন। রাজাগোপালচারী এর পক্ষে ছিলেন না, অন্যদিকে নেহেরু ও মাওলানা আজাদ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। অনেক আলোচনার পরে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দেয়। পক্ষে না থাকলেও, দলের সিদ্ধান্তে নেহেরু ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট নেহেরু ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করে। তারা প্রায় সবাই ১৯৪৫ এর জুন মাস নাগাদ কারাবন্দি ছিলেন। যাক সেসব কথা। নেহেরুকে বলা হতো ‘প-িত নেহেরু’। তিনি ছিলেন একজন কূটনৈতিক, লেখক ও দুরদর্শী রাজনীতিবিদ ব্যক্তি। আর তিনি যে কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন, সেটি হলো মেয়ে ইন্দিরাকে কংগ্রেস বা ভারতের রাজনীতিতে একজন দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। ইন্দিরা গান্ধী সেটিই হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ব্রিটিশ শাসন থেকে। সে বছরই ইন্দিরার বাবা জওহরলাল নেহেরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন (১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহেরু মারা যান অসুস্থ হয়ে)। তখন থেকেই ইন্দিরা প্রায় ছায়ার মতো বাবার পাশে পাশে থাকতেন। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। নেহেরুকন্যারূপে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ইন্দিরার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬৬ সালে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোট পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। একটানা ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইন্দিরা গান্ধী। এ পর্যায়ে রাজন্য ভাতা বিলোপ, ব্যাংক জাতীয়করণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি রূপায়ণ করেন। এখানে বলতে হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭৫ সালে তিনি দেশে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ জরুরি আইন জারি করেন। এজন্য সমালোচিত হন ইন্দিরা গান্ধী। এরপর ১৯৮০ সালে চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী এবং প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে শিখদের পবিত্র ধর্মাশালা স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনা হানা দেয় (যা অপারেশন ব্লু-স্টার নামে পরিচিত ছিল)। তার খেসারত ইন্দিরা গান্ধী দেন সে বছরই (১৯৮৪ সাল) ৩১ অক্টোবর। তার নিজের দেহরক্ষীর হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের মৃত্যুর দিন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রীরূপে কার্যভার গ্রহণ করেন রাজীব গান্ধী। ১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাজীব রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে রাজীব ও তার মা ইন্দিরা গান্ধী ডায়েরি লিখতেন। তাদের লেখা ডায়েরি কলকাতায় বাংলা ভাষায়ও প্রকাশিত হয়, যা আমি সংগ্রহ করে পড়েছি। রাজীব তার ডায়েরির এক জায়গায় লিখেছেন, ‘রাজনীতিতে আসা আমার কখনও ইচ্ছে ছিল না। সোনিয়া রাজনীতি পছন্দ করত না। ক্যামব্রিজে পড়ার সময় সোনিয়া আমাকে বলেছিল যেন রাজনীতিতে না জড়াই। আমিও সায় দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে রাজনীতিতে আসতেই হলো। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। আমি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী। কী জীবন! আমার ছেলেমেয়েকে সময় দিতে পারি না। সকালে যখন বের হই, তখন তারা ঘুমে, আবার রাতে এসেও দেখি তারা ঘুমে। সোনিয়াও আমার এ জীবন পছন্দ করেন না।’ আসলেই রাজীব থেকে সোনিয়া রাজনীতির প্রতি খুব একটা আন্তরিক ছিলেন না। রাজনীতিতে পদার্পণের আগে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক পেশাদার বিমানচালক। ক্যামব্রিজে থাকাকালীন ইতালীয় বংশোদ্ভূত সোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং পরে ১৯৬৮ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮০ সালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজীব রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তার নেতৃত্বে কংগ্রেস সংসদের ৫৪২ আসনের ৪১১টিতে জয়লাভ করে। এ জয় ছিল ভারতীয় সংসদে কংগ্রেসের সর্বকালের রেকর্ড। রাজীব গান্ধী লাইসেন্স প্রথা, শুল্ক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য অনুমতি প্রদানের নিয়মনীতি ঢেলে সাজান; টেলিযোগাযোগ ও শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধন প্রভৃতি নানা কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলমের (পিএলওটিই) মতো জঙ্গি তামিল গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করে মালদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার শান্তি প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ করেন এবং পরে সে দেশে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর সঙ্গে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্মুখ সমরের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি বোফর্স কেলেঙ্কারি তার সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তিটি নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে তার দল কংগ্রেসের। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। এ বছরই একটি নির্বাচনি জনসভায় এক এলটিটিই জঙ্গির আক্রমণে নিহত হন তিনি। ১৯৯৮ সালে তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ২০০৪ সালে তার নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভায় জয়লাভ করে। একটি কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সোনিয়া গান্ধী কখনোই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। এছাড়া তিনি ভারতীয় রমণীও নন। যে কথাটি ২০০৪ সালে ছড়িয়ে পড়লে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও নেননি। ব্যক্তিজীবনে সোনিয়া বিচক্ষণ হলেও রাজনীতিতে ততটা নন। তারপরও তিনি কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন অনেকটা চাপের মুখেই। তার পুত্র রাহুল গান্ধী যিনি কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, একধরনের সরল মানুষ রাহুল। এছাড়া রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা আছে বৈকি। ভারতবর্ষের মতো একটি দেশ আর কংগ্রেসের মতো একটি দল চালানো কি এতটাই সহজ? হ
ষ এবি সিদ্দিক
সাংবাদিক
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |