logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, মে ৩০, ২০১৯
রমজান ও ঈদ অর্থনীতি
এমএ মাসুম

সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উৎসব উপলক্ষে ভোগ্যপণ্যের বিকিকিনি বেড়ে যায় এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের রমজান এবং রমজান-পরবর্তী ঈদুল ফিতর। ফলে এ সময়ে অভ্যন্তরীণ পোশাকসহ বিভিন্ন ব্যবহারিক পণ্যের বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও জোগান দেখা যায়

রমজান ও ঈদুল ফিতর মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের মৌসুম। রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারায় পরিবর্তন আসে, সেই সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে দেশের বিভিন্ন আর্থিক ও ধর্মীয় স্থানগুলোতে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান, বাজারগুলোর পথের ধারে, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকার ফুটপাতসহ বিভিন্ন স্থানে বসেছে ইফতারি বাজার। প্রতি বছর ঢাকা শহরের চকবাজার ও বেইলি রোডে বসে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ইফতারির বাজার। শতবছর ধরে চলে আসা চকবাজার ইফতার বাজারে বড় বাপের পোলায় খায়, শিক কাবাব, সুতি কাবাব, ছোপা রুস্তম মুঠিয়া, বটি কাবার, জালি কাবাব, রেশমি কাবাব, পাখির রোস্ট, হাস-মুরগির রোস্ট, মুরগ মোসাল্লাম, সমুচা, শিঙাড়া, ঘুগনি, ছোলা, পেঁয়াজু জিলাপিসহ শত পদের সমাহার লক্ষ করা যায়। বিশ্বজুড়ে রোজাদারদের ইফতারের খাবারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খেজুর। ফল আমদানিকারকদের তথ্য মতে, দেশে ২০ আইটেমের খেজুর আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত খেজুরের মধ্যে রয়েছেÑ দাবাশ, তিউনিশিয়া, নাগাল ব্রাউন, দারাশ, বারিআরি মরিয়ম খেজুর ইত্যাদি। রমজানে সব ধরনের নিত্যপণ্যে, বিশেষ করে ভোজ্য তেল, ছোলা, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের আমদানিও বেড়ে যায়। মূলত রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের বহু প্রতীক্ষিত মহা আনন্দের দিন ‘ঈদুল ফিতর’ আসছে আর মাত্র কয়েকদিন পরই। ঈদ মানেই খুশির উৎসব, আনন্দের উৎসব। ঈদ সারা বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দঘন দিন। অর্থনীতিবিদদের মতে, নানা ধরনের সংকটের মধ্যেও এ বছরের ঈদে বিগত বছরের চেয়ে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধি পাবে এবং অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সারা দেশে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক লেনদেন হবে। জানা যায়, ঈদপণ্যের দামও গত বছরের চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে দেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। 
প্রতি বছরের মতো এবারও প্রবাসীরা ঈদ উপলক্ষে বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যাংক তাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উৎসাহিত করার জন্য গ্রাহকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ চালু করেছে। অন্যদিকে পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব অর্থ প্রবাহ চলে যাচ্ছে ঈদবাজারে। ঈদে সব বয়সি মানুষই নিজেকে পরিপাটি ও সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করে। ঈদে চাই নতুন জামাকাপড়, সেই সঙ্গে নতুন আসবাবপত্র ইত্যাদি। তাই আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে দেশের বিভিন্ন শপিংমল, বিপণিবিতান, এমনকি ফুটপাতও। ঈদের মাসে যেমন সারা দেশের শপিংমল বা মার্কেটগুলো গতিশীল হয়, সেই সঙ্গে সারা দেশের কুটিরশিল্প, তাঁত শিল্প, দেশীয় বুটিক হাউসগুলোতেও কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে এবং বাড়ে আর্থিক লেনদেন। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের অনলাইন বাজার। নিত্যনতুন পণ্যের সমাহার, বিভিন্ন ছাড় ও উপহারের কমতি নেই ভার্চুয়াল এ বাজারে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদ সামনে রেখে জমজমাট অনলাইনের ঈদবাজারও। রোজার আগে অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রভাব থাকে। আর রোজা শুরুর পর থাকে আরেক ধরনের। রোজার আগে অর্থনীতি সচল থাকে ভোগ্যপণ্যকেন্দ্রিক। এ মাসে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলত শুরু হয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি।
এরই মধ্যে ঈদের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামের ছোট বাজার থেকে জেলা শহর, বিভাগীয় শহর সব জায়গায়। এসব জায়গায় এখন উপচেপড়া ভিড়, ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। ক্রেতারা দৌড়াচ্ছেন এক বাজার থেকে আরেক বাজারে। বিক্রেতারাও নির্ঘুম সময় অতিক্রম করছেন ক্রেতাদের পছন্দমতো পণ্য সরবরাহ করার জন্য। আজকাল উচ্চবিত্তের অনেকেই নাকি দেশে ঈদবাজার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাই তারা ছুটে বেড়ান ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপের নামিদামি মার্কেটে। ঈদের বাজারের সবচেয়ে প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে পোশাক। এর পরই রয়েছে ভোগ্যপণ্য। পোশাকের মধ্যে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, শাড়ি, লুঙ্গি ও টুপি প্রধান। এরপর রয়েছে জুতা, প্রসাধনী ও স্বর্ণলঙ্কার আর উচ্চবিত্তের জন্য রয়েছে গাড়ি, ফার্নিচার, নতুন ফ্ল্যাট ইত্যাদি। ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ ছাড় ঘোষণা দিচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ ঈদের নানা প্যাকেজ ঘোষণা করছে। পর্যটন প্রতিষ্ঠানও বসে নেই। কর্মব্যস্ত মানুষ ঈদের ছুটিতে যাতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গায় ভ্রমণ করতে পারে, সে জন্য পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে পরিবহন খাত ততই ব্যস্ত হয়ে উঠছে। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ব্যাংক মাসব্যাপী মাস্টারকার্ডের অফার ঘোষণা করেছে। এর আওতায় মাস্টারকার্ড, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডধারী লাইফস্টাইল পণ্যেও শতাধিক আউটলেটে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও ইফতার ও সাহরিতে মাস্টারকার্ড ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডধারীদের জন্য রেস্তোরাঁয় ছাড় রয়েছে।
ঈদকেন্দ্রিক বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য কেনার ধুম লেগে যায়। বিশেষ করে ভোক্তাদের সেমাই, চিনি, দুধ, কিশমিশ, গরম মশলা, শুকনা খেজুরসহ ঝাল খাবারের উপরকণ হলুদ, মরিচ, ধনেসহ মাংসের মশলার প্যাকেটজাত সামগ্রীর কেনাকাটায় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। শুধু নিজ পরিবারের জন্যই কেনাকাটা সারছেন না ভোক্তারা। ঈদকেন্দ্রিক প্রায় সব ভোগ্যপণ্য কিনে উপহারস্বরূপ অনেকেই পাঠিয়ে দেন নিকটাত্মীয়দের বাসাবাড়ি কিংবা গ্রামের স্বজনদের কাছেও। ভারী খাবার হিসেবে পোলাওর চালসহ অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত চিকন চালের কদরও দারুণ বৃদ্ধি পায়। এসব খাবারের রসনা বাড়াতে গরু, মহিষ, খাসি ও মুরগির মাংসের বেচাকেনাও বেড়ে যায়। এসব মজাদার খাবারকে আরও রসনাদায়ক করে তুলতে ব্যবহৃত আদা, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা, তেজপাতা, লেবু, টমেটো ও শসার চাহিদাও বাড়তে থাকে।
ঈদের কেনাকাটার অধিকাংশ জিনিসপত্রই নাকি আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। ছেলেমেয়েদের পোশাক, শাড়ি, পাদুকা, প্রসাধনী সামগ্রীসহ যাবতীয় সবকিছুই আসছে দেশের বাইরে থেকে। জানা যায়, ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড থেকেই আসছে অধিকাংশ পণ্য। ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, ঈদের কাপড়ের বাজারের ৭০ ভাগই দখল করে নিয়েছে বিদেশি পোশাক। এর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে ভারত, শাড়ি ও থ্রি-পিসের প্রায় সবই নাকি ভারতের। আবার তুলনামূলক কম হলেও অংশীদারিত্ব রয়েছে পাকিস্তানি পণ্যেরও। ঈদ এখন আর শুধু পোশাক ও খাবার সামগ্রী ক্রয়ের মধ্যে সীমাবন্ধ নয়, এর পরিধি ব্যাপক। 
ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। সনামধন্য লেখক-লেখিকার সমন্বয়ে পত্রপত্রিকাগুলো বের করছে ঈদসংখ্যা। অন্যদিকে রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে নাটক, সিনেমা তৈরি ও প্রচার নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। ফলে অর্থনৈতিক প্রবাহ বেড়েছে মিডিয়া জগতেও। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার দোকানের নরসুন্দর থেকে শুরু করে ঢাকার নামিদামি বিউটি পার্লারের কর্মীদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। শেষ মুহূর্তে নিজেকে আকর্ষণীয় করতে তরুণ-তরুণীরা ভিড় জমাচ্ছেন নগরীর সেলুন ও পার্লারগুলোতে। বাদ যাচ্ছেন না বয়স্করাও। চুলকাটা, রং করা, ভ্রু প্ল্যাক, ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউর আরও কত কী। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন বিউটি পার্লার গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ব্যস্ততা বেড়েছে কাপড় পরিষ্কার ও ইস্ত্রি করার জন্য লন্ড্রি দোকানগুলোতে। কাপড় শেলাইয়ের জন্য দর্জির দোকানগুলোতে কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। শুধু তাই নয়, তাঁতি, বুটিক হাউস, ডিজাইনার, কারুশিল্পী সবাই এখন ব্যস্ত। দর্জির দোকানের কারিগরদের চোখে ঘুম নেই, রাত-দিন কাপড় শেলাই করে যাচ্ছেন। জানা যায়, অত্যধিক ব্যস্ততার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান রমজান শুরু হওয়ার পরপরই নতুন করে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। 
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উৎসব উপলক্ষে ভোগ্যপণ্যের বিকিকিনি বেড়ে যায় এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের রমজান এবং রমজান-পরবর্তী ঈদুল ফিতর। ফলে এ সময়ে অভ্যন্তরীণ পোশাকসহ বিভিন্ন ব্যবহারিক পণ্যের বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও জোগান দেখা যায়। এছাড়া বিশেষ কিছু খাদ্যপণ্যের বাজার, নানা ধরনের বিনোদন, পরিবহন সেবা ইত্যাদিও থাকে বেশ চাঙ্গা। সব মিলিয়ে রমজান ও ঈদ বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হ

এমএ মাসুম
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
[email protected]

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]