
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, মে ৩০, ২০১৯ | |
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করে ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বুধবার দুপুর ২টার দিকে ফেনী জজকোর্টের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেন পিবিআই পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম। এদিকে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আসামির তালিকা থেকে ওসিকে বাদ রেখে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ায় আপত্তি করেছে বাদীপক্ষ। তারা প্রশ্ন তুলেছে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারী ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে কেন আসামি করা হয়নি?
এ মামলার মোট আসামির সংখ্যা ১৬। এর মধ্যে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতা রুহুল আমীন ও মাকসুদ আলমও রয়েছেন। মামলার অন্যতম আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলায় ফেনী আদালতে ১৬ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনীর পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, বুধবার দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের সোনাগাজী আমলি আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে তারা এ অভিযোগপত্র জমা দেন। পরিদর্শক শাহ আলম বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে এ মামলায় ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর ও মাদ্রাসার প্রভাষকও রয়েছেন আসামির তালিকায়। এছাড়া এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। আর ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালানোর অভিযোগে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম থেকে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালান। কিন্তু তাকে আসামি করা হয়নি। অভিযোগপত্রের শুনানির দিন আইনজীবীরা পিবিআইয়ের কাছে জানতে চাইবেন কেন তাকে আসামি করা হয়নি। প্রয়োজনে মামলার বাদী নুসরাতের ভাই নোমানের সঙ্গে আলাপ করে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি জানানো হবে। বৃহস্পতিবার অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে বলে তিনি জানান।
আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, ধারা অনুযায়ী মামলার বিচারকাজ চলবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। সেক্ষেত্রে আমলি আদালত থেকে মামলাটি ওই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করতে হবে। এরপর মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি হবে।
পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল জানান, পিবিআই মামলা তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে ৩৩ কার্যদিবসে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করেছে।
‘অভিযোগপত্রে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জড়িত পাঁচজনসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ওই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন ও সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম ওই হত্যাকা- বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’
পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল আরও বলেন, অভিযোগপত্রে ৯২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আর সাতজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিমূলক সাক্ষ্য দিয়েছেন।
‘আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রের সারমর্ম বিচারকের কাছে তুলে ধরেন। হত্যার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, হত্যার সময়ের ঘটনার ডিজিটাল স্কেচও আদালতে তুলে ধরেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।’
ইকাবাল বলেন, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও হত্যাকা-ে সহযোগিতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৪(১) ও ৩০ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পিবিআই অভিযোগপত্রে ১৬ আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- চেয়েছে।
মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, পিবিআই আদালতে যে অভিযোগপত্রটি দিয়েছে তার বিস্তারিত আমার এ মুহূর্তে জানা নেই। আমি দেখব অভিযোগপত্রে কারা আসামি হয়েছেন। তবে আমি মনে করি আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে এ মামলায় অভিযোগপত্রে আসামি করা উচিত ছিল। আমি আমার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, মামলার পর থেকে অনেক ধরনের হুমকি পেয়েছি। তবে আমরা একে আমলে নিইনি। যেখানে মেয়েকে হারিয়েছি, সেখানে নিজেরা বেঁচে থেকে কী করব? যেখানে নুসরাত হত্যার বিচারের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়েছেন, সেখানে আমাদের মেরে ফেললেও কোনো সমস্যা নেই। মামলার অভিযোগপত্রে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে আমরা আদালতের কাছে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।
১৬ আসামি হলেন সোনাগাজীর চরকৃষ্ণজয়ের কলিম উল্লাহ সওদাগার বাড়ীর কলিম উল্লার ছেলে এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা (৫৭), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মো. আহসান উল্লাহর ছেলে নুর উদ্দিন (২০), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূইয়া বাজার এলাকার নবাব আলী টেন্ডল বাড়ী মো. আবদুর রাজ্জাকের ছেলে শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক) ও চরগণেশ গ্রামের পান্ডব বাড়ীর আহসান উল্লাহর ছেলে মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর (৫০), পূর্ব তুলাতলি গ্রামের খায়েজ আহাম্মদ মোল্লাবাড়ীর আবুল বাশারের ছেলে সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের সৈয়দ সালেহ আহাম্মদের বাড়ীর রহমত উল্লাহর ছেলে জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), সফরপুর গ্রামের খান বাড়ীর আবুল কাশেমের ছেলে হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ও উত্তর চারচান্দিয়া গ্রামের সওদাগর বাড়ীর ইবাদুল হকের ছেলে আবছার উদ্দিন (৩৩), চরগণেশ গ্রামের আজিজ বিডিআর বাড়ীর আবদুল আজিজের (পালক বাবা) মেয়ে কামরুন নাহার মণি (১৯), লক্ষ্মীপুর গ্রামের সফর আলী সর্দার বাড়ীর শহিদুল ইসলামের মেয়ে উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), পূর্ব চরচান্দিয়া গ্রামের সোজা মিয়া চৌকিদার বাড়ীর আবদুল শুক্কুরের ছেলে আবদুর রহিম শরীফ (২০), চরগণেশ গ্রামের হাজী ইমান আলীর বাড়ী ওরফে মালশা বাড়ীর জামাল উদ্দিন জামালের ছেলে ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), চরগণেশ গ্রামের এনামুল হকের নতুন বাড়ীর এনামুল হক ওরফে মফিজুল হকের ছেলে ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), তুলাতলি গ্রামের আলী জমাদ্দার বাড়ীর সফিউল্লাহর ছেলে মোহাম্মদ শামীম (২০), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া গ্রামের ভূইয়া বাজার এলাকার কোরবান আলী বাড়ীর কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন (৫৫), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বোর্ড অফিস সংলগ্ন রুহুল আমিনের নতুন বাড়ীর মো. রুহুল আমিনের ছেলে মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।
এ মামলায় এজাহারভুক্ত আটজনসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। তাদের মধ্যে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১২ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে ওইদিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর মারা যান নুসরাত জাহান রাফি। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। এ মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১২ জন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তার ২১ আসামির মধ্যে ১৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এর মাঝে তদন্ত শেষে ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে এ চার্জশিট দিল পিবিআই।
হাইকোর্টে ওসি মোয়াজ্জেমের জামিন আবেদন : ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানি ঘটনার ভিডিওচিত্র ধারণ এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে আইসিটি আইনে দায়ের করা মামলায় আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন আসামি সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। মোয়াজ্জেমের পক্ষে বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের বেঞ্চে আবেদনটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা।
আইসিটি আইনের মামলায় গেল সোমবার মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। এ মামলায় ওই দিন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা আসামি সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ১২৩ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের আবেদনের শুনানি শেষে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |