
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, মে ৩১, ২০১৯ | |
প্রবীণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে যেতে আগ্রহী। বেশিরভাগ প্রবীণেরই পারিবারিক দায় থাকে না। তারা অনেকটা স্বাধীন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে চান। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে যেতে আগ্রহী। দর্শনীয় স্থান কিংবা ধর্মীয় স্থান পরিদর্শনে আকুলতা থাকে। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চান। গণপরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বল্প ভাড়ায় চলাচল করতে পারলে প্রবীণরা ভ্রমণে আগ্রহী হবেন
গণপরিবহনে চলাচল সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে ঢাকা শহরে গণপরিবহনে চলাচল ছিল কষ্টকর। এখন সারা দেশেই একই অবস্থা। ঢাকা শহরের ভেতর এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। যানজট তীব্র হলে সময় আরও বেশি লাগে। শুধু রাস্তায় আমাদের কয়েক লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়। যারা প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে বাস-টেম্পোতে আসা-যাওয়া করেন, কষ্টের কথা তারা বেশি বলতে পারবেন। যারা নানা কাজে ঢাকা শহরে আসেন তারা গণপরিবহনে চলাচল কতটা বেদনাদায়ক, তা উপলব্ধি করতে পারেন। তীব্র যানজট এবং ওঠানামার বিড়ম্বনা প্রবীণদের জন্য পীড়াদায়ক। বিশেষ প্রয়োজনে প্রবীণরা বাসে চলাচল করতে চাইলে বেশ কয়েকটি ঝামেলা পোহাতে হয়। প্রথমত, বাসে ওঠার সমস্যা। বাস স্টপেজে যাত্রীর ভিড় থাকে। ভিড় মোকাবিলা করে সহজে বাসে উঠতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, সিটের সমস্যা। লড়াই করে বাসে উঠতে পারলেও বসার সিট পাওয়া স্বপ্ন। ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ বসার সুযোগ পান। অন্যথায় দাঁড়িয়ে যেতে হয়। দাঁড়িয়ে আসা-যাওয়া ভীষণ কষ্টের। বেশিরভাগ প্রবীণের হাঁটু, কোমর, পিঠ, হাতে ব্যথা থাকে। এ ধরনের প্রবীণদের বাসে দাঁড়িয়ে চলাফেরা খুবই কষ্টের। অনেক বাসে দাঁড়িয়ে চলাচলের সময় ধরে দাঁড়ানোর সহজ কিছু থাকে না। ব্রেক কষলে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বাস থেকে নামার যন্ত্রণা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছলে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামা খুবই বিপজ্জনক। কন্ডাক্টর বলতে থাকবে, আগে বাঁ পা দেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নামতে হয়। দ্রুতগতিতে বাস থেকে নামতে গিয়ে অনেক সময় প্রবীণরা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। চতুর্থ, প্রচ- গরমে বাসের মধ্যে সিদ্ধ হতে হয়। বেশিরভাগ বাসে ফ্যান থাকে না। যে কয়েকটিতে থাকে তা আবার নষ্ট। পঞ্চমত, যাত্রী ছাউনি না থাকা। বাসে ওঠেন রাস্তা থেকে, নামেনও রাস্তার ওপর। ঝড়-বৃষ্টিতে প্রবীণরা বাসে উঠতে-নামতে পারেন না। যারা উঠতে-নামতে বাধ্য হন তারা ভিজে যান। ঝড়-বৃষ্টিতে সাধারণ মানুষ কোথাও একটু আশ্রয় পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ান। এ পরিস্থিতিতে প্রবীণদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ে। যাত্রীছাউনি না থাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে কষ্ট আরও বাড়ে। উপায়হীন প্রবীণরা বাসে চলাচল করেন। যাদের সামর্থ্য আছে তারা সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশায় যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা রিকশায় চলাচল করা প্রবীণদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। কারণ রিকশায় চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা প্রবীণের দুর্বলতার সুযোগ নেয়। বেশি ভাড়া দাবি করে। কাক্সিক্ষত স্থানে যেতে অস্বীকার করে ইত্যাদি। মারাত্মক শব্দদূষণে সাধারণ মানুষের জীবন বেহাল। আর প্রবীণরা মারাত্মক হাইড্রোলিক হর্ন শুনে আঁতকে ওঠেন। উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত প্রবীণ ব্যক্তিরা শব্দদূষণের কবলে পড়ে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রবীণদের টয়লেট ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে। বাসস্টপেজগুলোয় টয়লেট নেই। যেসব জায়গায় টয়লেট আছে সেখানে ঢোকা দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাসের চেয়ে ট্রেনে চলাচল করা প্রবীণদের জন্য অধিক সুবিধাজনক। কাছাকাছি দূরত্বে যেতে প্রবীণদের মধ্যে ট্রেনে ভ্রমণ অধিক জনপ্রিয়। কারণ ভাড়া তুলনামূলক কম। দাঁড়িয়ে যেতে হয় না। বেশিরভাগ সময় সিট পাওয়া যায়। আন্তঃনগর ট্রেনে সিট পাওয়া যায়। টয়লেট সুবিধা রয়েছে। ঝাঁকুনি তেমন একটা হয় না। যানজটের কবলে পড়তে হয় না। ট্রেনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ওঠানামা। প্লাটফর্ম থেকে গাড়িটি একটু উঁচু থাকে। প্রবীণদের মধ্যে হাঁটু-কোমরে ব্যথা থাকায় ট্রেনের কামরায় ওঠতে সমস্যা হয়। কমলাপুর স্টেশনে রাজশাহী-ঢাকার আন্তঃনগর ট্রেনগুলো ব্রডগেজ লাইনে চলে। ব্রডগেজে চলা ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে এলে তা প্লাটফর্ম থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। শারীরিভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এ ধরনের ট্রেনের কামরায় ওঠা বিপজ্জনক আর প্রবীণদের জন্য এটি মহাবিপজ্জনক। তাপানুকূল শ্রেণীতে ভ্রমণকারী বিশেষ ব্যক্তিদের কামরায় ওঠার জন্য কাঠের বিশেষ সিঁড়ি রয়েছে। মিটারগেজ ট্রেন লাইনের স্টেশনে ব্রডগেজ লাইনে চলাচলকারী ট্রেনের কামরা প্লাটফর্ম থেকে তুলনামূলক বেশি উঁচুতে থাকায় প্রবীণ এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের ওঠানামা সত্যিই অনেক কষ্টের। এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো অর্থ খরচ হবে না। কতগুলো কাঠের সিঁড়ি বানিয়ে ট্রেনের কামরার দরজায় ওঠানামার সময় লাগিয়ে দিলেই হলো। রেলস্টেশনে তৃতীয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীসাধারণের জন্য টয়লেট সুবিধা নেই বললেই চলে। কমলাপুর স্টেশনে আমি প্রথম শ্রেণী/তাপানুকূল বিশ্রামাগারে টয়লেট সুবিধা দেখি। স্টেশনের পাশে একটি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। সেখানে টাকার বিনিময়ে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। স্টেশনের ভেতরে অবস্থানকারী যাত্রীরা অনেকেই জানেন না কোথায় শৌচাগার রয়েছে। প্রবীণ ব্যক্তির প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে যতটা সম্ভব কাছাকাছি জায়গায় শৌচাগার নির্মাণ করা যেতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য অধিকাংশ মানুষই লঞ্চ-স্টিমারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। প্রবীণরা নৌপথে যাতায়াত করতে বেশি আগ্রহী। লঞ্চের ভেতর চলাচল করা যায়। বসার ব্যবস্থা সন্তোষজনক। আরামদায়ক কেবিন রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণী রয়েছে। খাবার গ্রহণের সুযোগ থাকে। পর্যাপ্ত শৌচাগার আছে। কম ভাড়ায় যাতায়াতকারী প্রবীণরা বিছানা পেতে শুয়ে-বসে যেতে পারেন। লঞ্চে চলাচল করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, লঞ্চে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা। সদরঘাট টার্মিনালে প্রচ- ভিড়ে যাত্রীরা সিঁড়ি দিয়ে লঞ্চে ওঠেন। সিঁড়ির দুই পাশে কোনো রেলিং থাকে না। আগের দিনের স্টিমারগুলোয় রেলিং ব্যবস্থা ছিল। সিঁড়িগুলো তেমন প্রশস্ত নয়। কাঠের সিঁড়ির মাঝখানে অনেকগুলো বাটন দেয়া থাকে। ফলে উঠানামায় সতর্ক হতে হয়। যেসব স্টেশনে পন্টুন থাকে না সেখানে নদীর পাড়ে নিচু করে সিঁড়ি দেয়া হয়। এসব সিঁড়ি দিয়ে প্রবীণের উঠানামা অতীব কষ্টের। মাঝেমধ্যে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনালে ভিড়তে পারে না। অন্য একটি লঞ্চের পেছনে ভিড়ে। যাত্রীরা এক লঞ্চ থেকে আরেক লঞ্চে উঠে তারপর টার্মিনালে আসতে পারেন। এক লঞ্চ থেকে আরেক লঞ্চে যাওয়া অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়। ঝড়-বৃষ্টির দিন হলে কষ্টের মাত্রা খানিকটা বাড়ে। সদরঘাটে প্রচ- যানজট থাকায় প্রবীণরা গন্তব্যে পৌঁছতে কাহিল হয়ে পড়েন। দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী নৌযানগুলো দোতলা-তিনতলা বিশিষ্ট হয়। অনেক প্রবীণের হাঁটু-কোমরে ব্যথা থাকায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারেন না। ফলে লঞ্চে দোতলা-তিনতলায় আরামদায়ক কেবিন এবং প্রথম শ্রেণীর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। গণপরিবহনে চলাচলের জন্য প্রবীণদের প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে। একই মনোভাব দেখাতে হবে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীদের প্রতি। মোটকথা, সব বয়সী মানুষের জন্য গণপরিবহন নিরাপদ এবং আনন্দদায়ক হোকÑ এটাই আমরা চাই। বাসে মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৯টি সিট সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রায় দেড় কোটি প্রবীণের কথা ভেবে বিশেষ করে অতিপ্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য বাসে সিট সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে যেতে আগ্রহী। বেশিরভাগ প্রবীণেরই পারিবারিক দায় থাকে না। তারা অনেকটা স্বাধীন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে চান। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে যেতে আগ্রহী। দর্শনীয় স্থান কিংবা ধর্মীয় স্থান পরিদর্শনে আকুলতা থাকে। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চান। গণপরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বল্প ভাড়ায় চলাচল করতে পারলে প্রবীণরা ভ্রমণে আগ্রহী হবেন। এতে তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো থাকবেন। প্রবীণ ভালো থাকলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারলে সবার জন্য ভালো। চলাফেরার ঝক্কি-ঝামেলা বেশি হলে প্রবীণরা ঘর থেকে বের হতে আগ্রহী হবেন না। ফলে প্রবীণ জীবন নিঃসঙ্গ-আনন্দহীন একঘেয়ে হয়ে পড়বেন। পরিবারে আটকে পড়া প্রবীণের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অসুস্থ প্রবীণ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেন। পরিবারের সদস্যরা প্রবীণ ব্যক্তির স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরোন্টলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |