
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, সোমবার, ফেব্রুয়ারী ৩, ২০২০ | |
দান হলো দেওয়া, বিলানো। দুনিয়ার কোনো বিনিময় ছাড়াই যে জিনিস অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে দেওয়া হয় তাকে বলা হয় দান। ঈমান-আমল ব্যতীত পরকালে সম্পদ সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম হলো অসহায়ের সহায় এবং অভাবগ্রস্তের অভাব দূর করা, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া, আর এটা হয়ে থাকে দান করার মাধ্যমে। দানের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, গচ্ছিত সম্পদ হেফাজতে থাকে। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বান্দার দান তার ওপর আল্লাহর ক্রোধকে সংবরণ করে। তাই এমনভাবে দান করা উচিত, যেন ডান হাতের দান বাম হাতও জানতে না পারে। অর্থাৎ কাউকে দেখানোর জন্য দান করা হলে সে দান অহংকারের কারণ হবে। কাজেই সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।
শত নেকি অর্জনের নিমিত্তে অভাবীদের প্রতি দানের হাত প্রসারে পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৬১নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘যারা নিজেদের ধনৈশ্বর্য আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্য বীজ, যা সাতটি শিষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শিষে একশত শস্যকণা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’
প্রিয় জিনিস ব্যয় করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা চির অবহিত আর কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পুণ্য লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ প্রিয় জিনিস থেকে দান না করা হবে। সে ব্যাপারে সূরা আলে ইমরানের ৯২নং আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘তোমরা যা ভালোবাস তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনও পুণ্য লাভ করবে না। তোমরা যা কিছু ব্যয় কর আল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।’
আল্লাহ তায়ালা অভাবী, দুর্বল ও অসহায়-অনাথ ব্যক্তিদের নিরপরাধ সাব্যস্ত করে পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার ৯১নং আয়াতে বলেন, ‘যারা দুর্বল, যারা পীড়িত এবং যারা অর্থ সাহায্যে অসমর্থ, তাদের কোনো অপরাধ নেই, যদি আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি তাদের অবিমিশ্রিত অনুরাগ থাকে, যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো হেতু নেই; আল্লাহ ক্ষমাশীল পরমদয়ালু।’
হাদিসে এসেছেÑ ‘যে দুনিয়াতে কোনো মানুষের অভাব দূর করবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার অভাব দূর করবেন।’
সাহাবায়ে কেরামের জামানায় কোনো ভিক্ষুকের আগমন ঘটলে তারা মারহাবা ও অভিনন্দন জানাতেন। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘হজরত আলী ইবনে হুসাইন (রা.) এর কাছে যখন কোনো ভিক্ষুক আসত তখন তাকে মারহাবা ও স্বাগতম জানাতেন এবং বলতেন, এরা আমার সম্পদ ইহকাল থেকে পরকালে স্থানান্তর করে দিচ্ছে।’ (কিতাবুল বির পৃ. ২১৬)।
দুনিয়ার বুকে অনেক ভিক্ষুকই আছেন যারা আসলে কোনো ভিক্ষুক নন। যদিও তারা মানুষের রূপ ধরে আসেন। কারণ এর দ্বারা মানুষকে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রাপ্ত নেয়ামতের ওপর পরীক্ষ চালিয়ে থাকেন।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘মানুষের কাছে কখনও কখনও এমন ভিক্ষুক আসে যারা মানবও নয় জিনও নয় বরং তারা আল্লাহর ফেরেশতা, যাকে দিয়ে মানুষকে খোদাপ্রদত্ত নেয়ামতের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়Ñ তারা কোন ধরনের আচরণ করে।’ (কিতাবুল বির, পৃ. ২১৬)।
হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ফরমান, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে প্রার্থনা করবে, তাকে আশ্রয় দান করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে সাহায্য তলব করবে তাকে সাহায্য করবে। যে ব্যক্তি তোমার উপকার করবে তার প্রতিদান দেবে। যদি কোনো প্রতিদান দিতে না পার তাহলে তার জন্য দোয়া করতে থাক, যতদিন পর্যন্ত না তোমার বিশ্বাস জন্মাবে যে, তুমি তার প্রতিদান পূর্ণ করে দিয়েছ।’ (আবু দাউদ, পৃ. ২৩৫)।
আল্লাহর নামে ভিক্ষা চাওয়ার পরও অনেকে এটাকে প্রতারণা-ধোঁকা ইত্যাদি বলে কেটে পড়েন। অথচ দান করা হলে তা কোনো দিন বিফলে যাওয়ার অবকাশ নেই। কারণ যে ধোঁকা দিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই হবে। আর যে দান করেছে সে পরকালে বিজয়ী হবে। এ ক্ষেত্রে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট ব্যক্তি কে বলব কি? আমরা বললাম জি, হ্যাঁ! রাসুল (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দোহাই দিয়ে চায় এবং তাকে যে না দেয়।’ (নাসায়ি পৃ. ২৫৮)।
ভিক্ষুককে ফিরিয়ে না দেওয়ার ব্যাপারেও হাদিসে অনেক সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে উম্মতের নির্দেশনার জন্য উৎসাহমূলক আলোচনা এসেছে।
হজরত হাছান বসরি (রহ.) বলেন, মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণিকে (সাহাবায়ে কেরাম) পেয়েছি যারা ঘরের লোকদের গুরুত্ব সহকারে বলে দিতেন, কোনো ভিক্ষুককে যেন ফেরত না দেওয়া হয়। (কিতাবুল বির পৃ. ২১৬)।
অথচ আজ আমাদের সমাজ এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যে, কে ভিক্ষুক, কে ধোঁকাবাজÑ তা চেনাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় রাস্তায়, নামাজ শেষ হলে মসজিদের দরজায় সর্বত্রই ভিক্ষুকের আনাগোনা। অবশ্য দু-একজন অঙ্গ বিকলাঙ্গ ছাড়া বাকি সবাই প্রত্যক্ষভাবে সুস্থ। তাদের ভেতরের অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন। এরপরও কেউ তাদের খাঁটি মনে নেক নিয়তে সামান্য থেকে সামান্য দান করলেও এর প্রতিদান পাহাড় পরিমাণ হবে। একটু সচেতনতা ও সজাগ দৃষ্টির সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে দান করলেই হয়। শুধু শুধু একজনের হাত পাতার কারণে ভিক্ষুকের জাত ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা অনুচিত। ঠিক তো নেই আগামীকাল আমিও ফকির হয়ে যেতে পারি। কবি তো সঠিক বলেছেনÑ ‘সকাল বেলার আমির রে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা।’ আজ আমি যে অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, গাড়ি-বাড়ি আর নারী নিয়ে আমোদে লিপ্ত, বলা তো যায় নাÑ একদিন যে আমাকেও তার মতো পথের ভিখারি হতে হবে। হজরত আমর ইবনে মাইমুন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘পাঁচ জিনিসের আগে পাঁচ জিনিসকে মূল্যায়ন কর। ১. বার্ধক্যের আগে যৌবনের। ২. অসুস্থতার আগে সুস্থতার। ৩. দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতার। ৪. ব্যস্ততার আগে অবসরের। ৫. মৃত্যুর আগে জীবনের।’ সুতরাং যৌবন, সুস্থতা, সচ্ছলতা, অবসরতা ও জীবনÑ এ পাঁচটির মূল্যায়ন করা চাই। দানের মাধ্যমে সচ্ছলতারও মূল্যায়ন সম্ভব।
আর কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে এক পা এগিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। ১. জীবন কীভাবে ব্যয় হলো? ২. যৌবন কোন কাজে ব্যয় হলো? ৩. কীভাবে রোজগার করেছ? ৪. কোথায় কোন কাজে ব্যয় করেছ? ৫. ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছ? সুতরাং হালাল উপায়ে রোজগার তথা আয়ের মাধ্যমে আমাদের ব্যয়ের খাতও যদি দানের মধ্যে থাকে তবে পরকালে এর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে উত্তম বিনিময়।
‘নাহি পাই কাজ তাই ত্যাজি লাজ বেড়াই ভিক্ষা করি, হে দয়াল নবী দাও কিছু মোরে নইলে পরাণে মরি। আরবের নবী করুণার ছবি ভিখারির পানে চাহি, কোমল কণ্ঠে কহিলÑ তোমার ঘরে কি কিছুই নাহি?... নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত করো সবে।’ রাসুলের জামানায় এক ফকির তাঁর কাছে ভিক্ষার জন্য এলে তিনি তাকে কুঠার কিনে বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আর কবি এটাকে চিত্রায়িত করেছেন চৌদ্দশ’ বছর আগের ঘটনাটি কেন্দ্র করে। কারণ যারা কাজ করতে সক্ষম রাসুল (সা.) তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন। সমাজের প্রতিটি অধ্যায়ে অনাথ-অভাবীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্বদান অত্যাবশ্যক। এটাই রাসুলের শিক্ষা। কাজেই প্রকৃত অসহায়-অভাবীদের প্রতি কোরআন-হাদিসে দানের নির্দেশনা অনুযায়ী দানের হাত সম্প্রসারণ করার মধ্যে রয়েছে সফলতা। দুনিয়ার এ অর্থ-সম্পদ ব্যয় হোক সঠিক পথে, সঠিক উপায়ে। সবার মাঝে তৈরি হোক অন্যের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি। একে একে অপরের জন্য এগিয়ে আসার মাধ্যমে বিশ্বপাড়া হয়ে উঠুক আরও সমৃদ্ধÑ এটাই প্রত্যাশা করি।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |