প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বুধবার, ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২০ | |
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ে আনডিজিটাল দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম যোগসাজশে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত মূল্যে ডিজিটাল বায়োমেট্রিক মেশিন কিনতে বাধ্য করেছেন। এ প্রক্রিয়ায় উপজেলার ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাজিরার জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার জন্য ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোভাবেই নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার জন্য বাধ্য করা যাবে না বলেও নির্দেশ রয়েছে; কিন্তু দিঘলিয়া উপজেলার ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়ের জন্য সিন্ডিকেট তৈরি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে দু’দফায় শিক্ষকদের ডেকে ‘ইনোভয়েস’ নামে নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী মেশিন প্রতি ২২ হাজার টাকা মূল্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ মেশিন কিনতে বাধ্য হন। পছন্দের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সিন্ডিকেট করে এ মেশিন কেনা হয়। এসব মেশিন নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিম্নমানের ওই বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিনের বাজার মূল্য ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু সিন্ডিকেটের ধার্যকৃত ২২ হাজার টাকায় বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ৫০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষদের ক্রয় করতে বাধ্য করেছে। আর অতিরিক্ত অর্থ ওই সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। উপজেলার ৫০টি বিদ্যালয়ের সবক’টিতে ২২ হাজার টাকায় এ মেশিন ক্রয়ের বিল ভাউচারও দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজিরা মেশিন ক্রয়ে এমন অর্থ বাণিজ্যের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা; কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাননি। সূত্র জানায়, সরকারি বিদ্যালয়ের স্বাধীনভাবে এ মেশিন ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে। স্কুলে সরকার প্রদত্ত স্লিপের টাকা থেকে এ মেশিন ক্রয় করা হয়। সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ ও শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম ক্ষমতার অপব্যবহার করে শিক্ষকদের জিম্মি করে তাদের বেঁধে দেওয়া ২২ হাজার টাকা দামে পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি দামে ওই মেশিন কিনতে বাধ্য করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিযোগ করেন, ডিজিটাল বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ ও শিক্ষা কর্মকর্তা শাহানাজ বেগম শিক্ষকদের জিম্মি করে পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি দামে ওই মেশিন কিনতে বাধ্য করেছেন। এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ ডিজিটাল বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ের আগে তার অফিসে ৫০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দুই দিন ডেকে মেশিন কেনার জন্য চাপ দেন। আর এ বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে কিছু বলতে নিষেধ করা হয়। উপজেলার অন্তত ১৫ থেকে ২০টি স্কুল পরিদর্শন করে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেও এ বিষয়ে তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ লক্ষ করা গেছে।
উপজেলার ৮নং উত্তর দিঘলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রূপা দে ও বারাকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আল-মামুনসহ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ডিজিটাল বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক মেশিন বাবদ ২২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।
উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. কামরুল ইসলাম বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তাদের দু’দফায় ডেকে মেশিন ক্রয়ের ব্যাপারে ৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেন। পরে যাচাই-বাছাই করে সব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেই একটি প্রতিষ্ঠানের মেশিন কিনতে বলা হয়। সেভাবেই উপজেলার ৫০টি স্কুলে মেশিন কেনা হয়েছে। তবে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এভাবে সমন্বয় করে একটি প্রতিষ্ঠানের মেশিন ক্রয়ের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই এবং এতে ব্যবহারের পর ভালো-মন্দা যাচাইয়ের সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে না বলেও স্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বলেন, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে দু’দিন বসে শিক্ষকদের নিয়ে সভা করা হয়। ওই সভা থেকেই সব স্কুলে ভালো মানের মেশিন ক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান এবং মেশিনপ্রতি ২২ হাজার টাকা করে মূল্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তবে, এতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম সিরাজ-উদ-দোহা বলেন, স্কুলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দমতো ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয় করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকতে পারবে না। তবে, দিঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগমের এ ধরনের সম্পৃক্তার বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও জানান।
এ বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ রোববার বলেন, তিনি জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তার অফিসে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কোনোক্রমেই তিনি এ প্রসঙ্গে সেলফোনে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি কথা শেষ হওয়ার আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
উল্লেখ্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (উন্নয়ন-২) শাখার যুগ্ম সচিব মো. রুহুল আমিন স্বাক্ষরিত গত বছরের ২৩ অক্টোবরের একপত্রে উল্লেখ করা হয়, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে যাচাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে নিজেদের পছন্দমতো ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয় করে স্কুলে স্থাপন করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিভিন্ন স্থানে বিভাগীয় পরিচালক, জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা একটি নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়ে বাধ্য করছেন। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। নিজ নিজ বিদ্যালয় স্বচ্ছতার সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মেশিন ক্রয় করবে। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |