প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ৭, ২০২০ | |
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করতে গিয়ে প্রচ- বিক্ষোভের মুখে পড়েন। বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৭ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে বেলুচিস্তানকে বলপূর্বক পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পশতুন অধ্যুষিত এ এলাকাটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি ছিল না। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে পাকিস্তান বাহিনী অতি সহজেই এলাকাটিকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং বেলুচরা অসহায় আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার দাবিতে এখানে আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার কাছে তারা বারবার পরাস্ত হয়। তাই বলে তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম থেমে থাকেনি। এই আন্দোলন দমনে পাকিস্তান সর্বশেষ বেলুচিস্তানে ফোন সার্ভিস ও ইন্টারনেট পরিষেবা নিয়ন্ত্রণসহ জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তারা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠগুলোকে বেলুচিস্তান প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং পাকিস্তান সরকারের স্বার্থের পরিপন্থি সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা কঠোরহস্তে দমন করছে। এছাড়া দেশটির সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশের ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীরা এখন প্রায়ই গুম ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, বেলুচিস্তানের জনগণ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর ও চীনের বিরোধিতা করার কারণে ভয়াবহ আক্রোশের শিকার হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পিটিএম (পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্ট) নেতা মঞ্জুর পাশতিনকে গেল ২৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে পেশোয়ার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে পাকিস্তান যে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, সে দেশে কোনো সন্ত্রাসবাদ নেই এবং যা কিছু হচ্ছে তা আফগানিস্তান থেকে আসছে। বাস্তবে তারা একদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং অন্যদিকে ভারত ও অন্যান্য দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে সমর্থন জোগাচ্ছে। তাদের এই দ্বৈত চরিত্র আরও নিখুঁতভাবে ধরা পড়ে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়Ñ উইঘুরের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপনি মুখ খুলছেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘চীন তাদের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কী আচরণ করছে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এ বিষয়ে পাকিস্তানের কোনো মন্তব্য নেই। কেননা চীন আমাদের জন্য অনেক করেছে।’ ইমরান খান একদিকে নির্লজ্জভাবে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, অন্যদিকে চীনে ১০ লাখেরও বেশি মুসলমানকে অন্যায়ভাবে বন্দি করার ঘটনায় চোখ বুজে থাকছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘন পাকিস্তানের জন্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় দেশটির বিভিন্ন স্থান থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেÑ আছিয়া বিবি (আছিয়া নওরিন) মামলা। খ্রিস্টান নারী আছিয়া বিবিকে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোকের সামনে ঘর থেকে টেনে বের করে মারধর করার পর গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করা হয়। বিচার চলাকালে আছিয়া নিজেকে নিরপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরও ২০১০ সালে আদালত তাকে মৃত্যুদ- দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট যথাযথ প্রমাণের অভাবে আছিয়ার সাজা বাতিল করে। এ রায়ে অবশ্য পাকিস্তানের গোড়া মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়। তাই রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আছিয়ার মৃত্যুদ- বহাল রাখার দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়। তারা সড়ক অবরোধ এবং থানা আক্রমণ করে। এ সময় দোকানপাট ও স্কুল-কলেজ বলপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পকিস্তান সরকার নীরবতা পালন করে। ২০১১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসির নিজ দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরির গুলিতে প্রাণ হারান। পাকিস্তানের জনগণ খুনি মমতাজ কাদরিকে ‘মহাপুরুষ’ ঘোষণা দেয় এবং তার নামে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়। সালমানের অপরাধ তিনি আছিয়া বিবির পক্ষে লড়াই করছিলেন। অন্যদিকে ধর্ম অবমাননা আইনের কট্টর সমালোচক হওয়ায় ২০১১ সালে মন্ত্রী শাহবাজকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
আছিয়া বিবি এখন কানাডার এক অজ্ঞাত স্থানে বসবাস করছেন। তার একটি আত্মজীবনী সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে পাকিস্তানি কারাগারের নারকীয় পরিবেশের বর্ণনা রয়েছে। গেল ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘অবশেষে মুক্তি পেলাম’ নামের বইটিতে আছিয়া বিবি তাকে গ্রেপ্তারের পরম্পরা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, তাকে জেলখানায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো এবং অন্য করাবন্দিরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করত।
পাকিস্তানের দ্বৈত নীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেÑ তারা একদিকে কাশ্মীরি জনগণের প্রতি দরদ দেখাচ্ছে, অন্যদিকে তারা ওই ভূখ-ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ও তাদের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও একতা প্রকাশ এবং কাশ্মীরি শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কাশ্মীর দিবস সর্বপ্রথম পালিত হয় ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের তদনানিন্তন বিরোধীদলীয় নেতা ও পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আহ্বানে। ওই সময় নওয়াজ শরিফ তার ভাষায় কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। এরপর থেকে প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীর দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিন জিহাদি ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সভা-সমাবেশের আয়োজন, অর্থ সংগ্রহ এবং কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জিগির তোলে। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক তাগাদা সত্ত্বেও পাকিস্তান কার্যত তাদের উৎসাহিতই করে থাকে। ৫ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে বহু জঙ্গিবাদী নেতা ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার জন্য সমাবেশের আয়োজন করে এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়। আন্তর্জাতিক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন জয়েশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) প্রধান মওলানা মাসুদ আজহার (২০১৯ সালের মে মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত) এবং মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও জঙ্গি সংগঠন ‘লস্কর-ই-তাইয়্যেবা’ প্রধান হাফিজ সাঈদকেও এইদিন প্রকাশ্যে বক্তৃতাবাজি করতে দেখা যায়। পাকিস্তানভিত্তিক বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন এই দিনটিতে তাদের সভা-সমাবেশে উলঙ্গভাবে সশস্ত্র জিহাদের উসকানি দেয় এবং চাঁদাবাজি করে থাকে।
এটা এখন আর কোনো গোপন কিছু নয় যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং ভারতীয় সেনা চৌকিতে হামলা পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সমাবেশ ঘটায়। তারা এলইটি, কেইএম ও আল-বদরসহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদের কাছাকাছি অবস্থিত ঘাঁটিগুলোতে প্রশিক্ষণ দেয়। অতীতেও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকা জঙ্গি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের ওপার থেকে আসা জঙ্গিদের দমনে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জয়েশ-ই-মোহাম্মদের আস্তানায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক (বিমান হামলা) চালায়। এসময় জঙ্গিদের দুটি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
বিশ্ব সম্প্রদায় আজ পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের চারণভূমি হিসেবে চিহ্নিত করছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের আর্থিক সহায়তার ঝুঁকি কমাতে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর ‘ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সে’র (এফএটিই) পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মূলত পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এবং এ মাসে অনুষ্ঠিতব্য এফএটিএএফের বৈঠকে সন্ত্রাস দমনে তাদের সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সম্ভবত এ কারণে পাকিস্তান কালো তালিকাভুক্ত অর্থাৎ সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তকমা পেতে চলেছে। এর ফলে দেশটির ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতি অধিকতর বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
ফারাজী আজমল হোসেন
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |