logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, ফেব্রুয়ারী ৯, ২০২০
বঙ্গবন্ধুর অজানা গল্প
নির্মলেন্দু গুণ

 


১৯৯০ সালে আমি যখন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গিয়েছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু মৌলানা শেখ আবদুল হালিমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ইসলামসম্মত সব বিধি মান্য করে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং ওই রাতে ঘরে ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরবি ভাষায় একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। ওই কবিতাটি আমি তার কাছ থেকে লিখে নিয়ে এসেছিলাম এবং বাংলায় অনুবাদ করে সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলাম। ওই কবিতাটিই ছিল বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা। ওই ঘটনাটি আমি আগে লিখেছি।
আজ মৌলানা শেখ আবদুল হালিমের কাছে শোনা অন্য একটি ঘটনার কথা লিখছি। আমি মৌলানা শেখ আবদুল হালিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে তো আপনি খুব ছোটবেলা থেকে দেখেছেন। জেনেছেন। তার সম্পর্কে এমন কোনো ঘটনার কথা কি আপনি আমাকে বলবেন, যে ঘটনাটি আপনার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, তার সম্পর্কে ভাবতে গেলে যে ঘটনাটির কথা আপনার খুব মনে পড়ে? যে ঘটনাটি আপনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না? 
মৌলানা হালিম আমার প্রশ্নটি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। মনে হলো তিনি স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। আমি চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার কপালে চিন্তার বলিরেখা। ঠোঁট দুটি কাঁপছে তার। তিনি চোখ মেললেন। আধো আলো আধো অন্ধকারে আমি লক্ষ্য করলামÑ তার চোখের পাতায় অশ্রু জমেছে।
তাকে সহজ হতে সাহায্য করে আমি বললাম, কিছু কি মনে পড়ল? আপনার চোখে জল কেন? 
তিনি বললেন, একটি ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে, আর সে ঘটনাটির কথা মনে পড়লেই আমার কষ্ট হয়, আমার চোখে পানি এসে যায়।
আমি তার মুখ থেকে ওই ঘটনাটি শোনার জন্য কিছুটা উত্তেজিত বোধ করি। বলি, বলুন শুনি ওই ঘটনাটির কথা। আমার বিশ্বাস ওই ঘটনাটির কথা, যা আপনি গোপনে বয়ে চলেছেন আপনার বুকের ভেতরে, সে ঘটনাটির কথা আমার কাছে প্রকাশ করলে আপনার বুকটা হালকা হবে।
তিনি একটু হাসলেন আমার কথা শুনে। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে আমি একটা কষ্ট দিয়েছি। তার মৃত্যুর পর থেকেই এরকম একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে চলেছে। আমার কেবলই মনে হয়, আমার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি।
আমি বললাম, এমন কী কষ্ট আপনি দিয়েছেন তাকে, যার জন্য আপনি এখন কষ্ট পাচ্ছেন?
তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু খুব জাঁকজমক করে তার চল্লিশার (চেহলাম) আয়োজন করেছিলেন। আমাকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার বাবার মঙ্গল কামনা করে কোরআন খতমে অংশ নেওয়ার জন্য। আমি তাকে বললাম, তুমি প্রচুর অর্থ খরচ করে তোমার বাবার জন্য যে বিশাল আয়োজন করেছ এত অর্থ তুমি কীভাবে উপার্জন করেছ, এই নিয়ে আমার মনের মধ্যে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে একটু ব্যথিত হন।
আমি ভেবেছিলাম, তিনি জাতির পিতা, দেশের প্রসিডেন্ট, তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীÑ আমার ওপর রাগ হতে পারেন। কিন্তু না। আমার কথা শুনে তিনি একটুও রাগ হলেন না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হালিম, সত্য কথা বলার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান। অন্য কোনো মৌলানা তোমার মতো সাহস করে আমার কাছে তাদের মনে সংশয় থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। তোমার সৎসাহস আছে, তাই তুমি করেছ। মনে সংশয় নিয়ে তুমি যদি আমার বাবার মঙ্গল কামনা করে কোরআন শরিফ পড়তা, তাতে আল্লাহ নারাজ হতেন। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। আমার প্রিয় পিতার আখেরাতের মঙ্গলের জন্য আমি নিজেই কোরআন শরিফ পড়ব। তুমি আশেপাশে থাইকো, কোথাও কোনো ভুল হইলে আমারে বইলো।
আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, বঙ্গবন্ধু নির্ভুলভাবে, পবিত্র মনে সেদিন কোরআন শরিফ পাঠ করেছিলেন। ঘটনাটির কথা বলার সময় মৌলানা শেখ হালিমের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। 
আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন?
তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সততা নিয়ে মনে সন্দেহ পোষণ করাটা আমার উচিত হয়নি। আমি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তার মনে একটা খুব বড় রকমের কষ্ট দিয়েছি।
তাকে কবর দিয়ে ঘরে ফেরার পর থেকে আমি যখনই তার কথা ভাবি, যখনি আমি তার বাবা, মা এবং বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে যাই, তখনই ওই ঘটনাটার কথা আমার মনে পড়ে। আমার বুকটা ভারি হয়ে ওঠে। আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। তার আর্থিক সততা ও সংগতি নিয়ে সন্দেহ করার জন্য আমি পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে মাফ চাই। হ

ষ পিআইডি ফিচার

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]