
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, ফেব্রুয়ারী ৯, ২০২০ | |
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) চাঁদপুর নদীকেন্দ্র ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরের ওয়ারলেস বাজার মোড় এলাকায় চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ১৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে চাঁদপুর নদীকেন্দ্র অবস্থিত। দীর্ঘ ৩৫ বছর এ ইনস্টিটিউট গবেষণা করে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাছের উন্নত জাতসহ প্রায় ২০টি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এটি দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে অসামান্য অবদান রাখছে। বিশেষ করে এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রায় ২০ বছরে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।
চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের গবেষকদের নিরলস গবেষণায় অল্প কয়েক বছরে হুমকির মুখে থাকা ইলিশের উৎপাদন আশাতীত বৃদ্ধি পায়, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিরল। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ রোল মডেল। ইলিশ গবেষণায় সফলতা পাওয়ার পাশাপাশি ২০১৭ সালে ইলিশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) স্বত্ব লাভ করেছে বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, নতুন নতুন পদ্ধতিতে মৎস্য চাষের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও কাজ করে চলছে এ প্রতিষ্ঠান। এ নদীকেন্দ্রে ৪০টি স্থায়ী পুকুর, একটি হ্যাচারি এবং নদীতে জরিপকাজ ও পরীক্ষামূলকভাবে মাছ ধরার জন্য গবেষণা সরঞ্জামসহ একটি নৌযান রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদীকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এখানে নদীর পানির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, টেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও লিমানোলজিক্যাল ডিজিজ ল্যাব নামে একই সঙ্গে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তরসহ পাঁচটি কেন্দ্রের অন্যতম চাঁদপুর নদীকেন্দ্র। চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের উপকেন্দ্র হিসেবে আরও দুটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত নদী উপকেন্দ্র রাঙ্গামাটি ও পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত নদী উপকেন্দ্র খেপুপাড়া। চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের অধীনস্থ রাঙ্গামাটির নদী উপকেন্দ্র থেকে কাপ্তাই লেকে মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং খেপুপাড়ার উপকেন্দ্র থেকে ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন মৎস্য প্রজাতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত বিএফআরআই চাঁদপুর নদীকেন্দ্র গবেষণা করে মাছের উন্নত জাতসহ আধুনিক উপায়ে মাছ চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিশেষ করে ইলিশ সম্পদ রক্ষায় যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এতে করে দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে ইলিশ মাছ। চাঁদপুর নদীকেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণের কৌশল ও ব্যবস্থাপনা, পুকুরে পাঙাশ চাষে একক ও মিশ্র চাষাবাদ প্রযুক্তি, থাই পাঙাশ চাষের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন, গৃহাঙ্গন হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন, পুকুরে গলদা চিংড়ির একক ও মিশ্র চাষ, ধান খেতে মাছ চাষ, মাছ ও জলজ পরিবেশের ওপর কীটনাশকের বিষক্রিয়া নিরূপণ, কাপ্তাই হ্রদের জৈব ব্যবস্থাপনা ও জলাশয়তাত্ত্বিক সমীক্ষা, খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ, নদ-নদীর পানির নবায়ন ও দূষণবিষয়ক সমীক্ষা, ইলিশ মাছ গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা, পাঙাশ মাছের প্রতিপালন ও গবেষণা, থাই পাঙাশ মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ প্রমুখ। এ সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় এবং স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে। সূত্র মতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সব মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। চাঁদপুর জেলায় ৫৬ হাজার ৯৪৬ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ৯৯ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন। এছাড়া দেশের মৎস্য ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চাঁদপুর নদীকেন্দ্র একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৫ সালে থাই পাঙাশ মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য রৌপ্যপদক, ২০১০ সালে রুই মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখায় স্বর্ণপদক লাভ করে চাঁদপুর নদীকেন্দ্র। এরই মধ্যে ইলিশ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং ‘সিটি অব হিলশা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এমনকি দেশে সর্বপ্রথম থাই পাঙাশের সফল প্রজনন, ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং খাঁচায় মাছ চাষ উদ্ভাবন করেছেন এ নদীকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সম্পদ জরিপ পদ্ধতি (এফআরএসএস) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার আগে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.১৪ লাখ মেট্রিক টন, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ১৯ লাখ মেট্রিক টনে। ২০০০-০১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২ দশমিক ২৯ লাখ মেট্রিক টন, ২০০১-০২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ২ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরও কমে দাঁড়ায় ১.৯৯ লাখ মেট্রক টনে। পরবর্তীতে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রমাগতভাবে। এ সময় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয় ৩.৫১ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮৭ লাখ মেট্রিক টনে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩ দশমিক ৯৪ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন এসে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টনে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দেশের একমাত্র ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিনের গবেষণায় এ ইনস্টিটিউট বেশ ক’টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং সফলতা অর্জনও করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় মৎস্য অধিদপ্তরসহ সব স্টেক হোল্ডারের অংশগ্রহণের কারণে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে শুধু বৃদ্ধিই হয়নি, আকারেও বড় হয়েছে। নদীতে এখন সুস্বাদু ইলিশ কম-বেশি সারা বছরই পাওয়া যায়। এ বছর অসময়েও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বাংলাদেশকে মাছ উৎপাদনে আরও সমৃদ্ধ করার আশা রাখে।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |