
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০২০ | |
- তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ৭১ বার সময় বাড়ানো হয়েছে
-২৩ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য
- খুনি গ্রেপ্তার হয়নি, তদন্তেও অগ্রগতি নেই
- তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে সাতজন
- আল্লাহর কাছে বিচার চাইলেন হতাশ রুনীর মা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনী নৃসংশভাবে খুন হন। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন নিহতের স্বজন ও সাংবাদিকরা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও ঘটনাস্থলে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টায় ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ তো দূরের কথা, হত্যাকাণ্ডের আট বছর পার হলেও সাগর-রুনীর খুনিদের ধরতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির ন্যূনতম বাস্তবায়ন হয়নি। আট বছরে মামলার তদন্ত প্রতিবেদনই জমা দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উপরন্তু তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৭১ বার বাড়তি সময় প্রার্থনা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন সবমিলিয়ে সাতজন। এ পরিস্থিতিতে হতাশ ও শোকাহত রুনীর মা আল্লাহর কাছেই চাইছেন বিচার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। মূলত কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ খোঁজেন। এরপর আসামি শনাক্তকরণের চেষ্টা করেন; কোনো ধরনের ক্লু পেতে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এসব একটি মামলা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম। আট বছর তদন্তের পরও সাগর-রুনী হত্যা মামলা ঠিক এরূপ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। এখনও আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে তদন্ত সংস্থা র্যাব।
সোমবার এ মামলার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে নির্ধারিত দিনে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম। তাই ঢাকার মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্র্রেট দেবব্রত বিশ্বাস প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আবার ২৩ মার্চ দিন ধার্য করেছেন। এ নিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ৭১ বার পেছাল। ৭০ বারের মতো প্রতিবেদন দাখিলের দিন, অর্থাৎ ১১ নভেম্বর এ মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আট বছরেও শেষ
ষ ১ম পৃষ্ঠার পর
হতাশা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। মামলার তদন্তে র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম সেদিন উচ্চ আদালতকে জানান, তদন্তে কোনো ক্লু (সূত্র) পাওয়া যায়নি। চারটি ডিএনএ প্রতিবেদনের মধ্যে দুটি মিলেছে। এ দুটিতে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সেগুলো আবারও যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইয়ের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের ৬২ দিন পর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্তে ‘ব্যর্থতা’ জানালে আদালত র্যাবকে তদন্তভার দেন। তারা সাত বছর ১০ মাস ধরে তদন্ত করছেন। এ সময় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে ৭১ বার সময় প্রার্থনা করেন র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা। ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালত ৭০ বারের মতো সময় বাড়িয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেন। তবে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা সোমবারও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৭০টি অগ্রগতি প্রতিবেদনেই ‘গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম বলেন, সোমবার প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। আরও সময় লাগবে। সময় চেয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বিলম্বের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আসামি শনাক্তকরণ হয়নিÑ এ কারণে দেরি হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি গেল বছর মে মাসে মামলার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই মামলাটি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন। মামলার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। খন্দকার শফিকুল আলমের আগে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন র্যাবের আরেকজন এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ। তার আমলেও কোনো আগ্রগতি ছিল না। তিনিও প্রতিবেদন দাখিল করতে না পেরে বারবার সময় চেয়েছিলেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনী তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন রুনীর ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। সেই থেকে আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে এর আগে দাখিল করা প্রতিবেদনে ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনীর পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনীর পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।
এর আগে ৫৫তম প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএ-এর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃত আট আসামি, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজনÑ রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় (ডা. নিতাই) হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
ঢিলেঢালাভাবে তদন্ত চলায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। ছেলে ও পুত্রবধূর খুনিরা আট বছরেও গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন সাংবাদিক সাগর সারওয়ারের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে আমার সঙ্গে তদন্ত কর্তৃপক্ষের কেউ যোগাযোগ করেননি। এখন তদন্ত কর্মকর্তাকে আমরা চিনি না। ডা. নিতাই হত্যা মামলার কতগুলো আসামি, কিছু চোর-ডাকাতকে সাগর-রুনী হত্যা মামলায় আসামি করে ধরে রাখা হয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে তারা সাগর-রুনী হত্যা মামলায় জড়িত নয়। তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সত্যিকার খুনির শাস্তি চাই। আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছি।’
মামলার বাদী রুনীর ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা তো আদালতকে একটা কিছু জানাবেন। কিন্তু কোনো ফলোআপই জানাচ্ছেন না। আগ্রগতিই নেই। বরং বারবার সময় নিচ্ছেন; সর্বশেষ সোমবারও সময় চেয়েছেন। আদালতও যেখানে বারবার সময় দিচ্ছেন, সেখানে আমাদের আর কী বলার আছে!’ আট বছরেও খুনের রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে সাগর-রুনীর স্বজন ও সহকর্মীদের মধ্যে। তারা বলছেন, প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবেই এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে না। বিচারের দাবিতে আজ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) চত্বরে মানববন্ধন সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবেন সাংবাদিকরা।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |