
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২০ | |
প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এসব মানবিক গুণ আছে বলেই এখনও টিকে আছে এ নশ^র পৃথিবী। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম : ২১)। ভালোবাসার অভাবে মানুষ নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। ভালোবাসাশূন্য মানুষটির কাছে কেউই নিরাপদ নয়। সত্যিকার ভালোবাসার অভাবে সৃষ্টি হয় হিংসা-বিদ্বেষ, গুম, খুন ও ধর্ষণের মতো অসংখ্য অপরাধ। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। তাই তো পরম মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে রাসুল (সা.) এসেছিলেন এ ধরায়। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে বিশ^বাসীর জন্য ভালোবাসা ও রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)।
ভালোবাসা দিবস খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি : ভালোবাসা উদযাপনের জন্য ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ এর উৎপত্তি সম্পর্কে নানা ঘটনা প্রসিদ্ধ। একটি ঘটনা খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে রোমক সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের শাসনামলে। এ সময় ক্লডিয়াস একটি বিধান জারি করেন যে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না, কারণ বিবাহ সৈনিকদের যুদ্ধক্ষেত্রের দৃঢ়তাকে ব্যাহত করে। এ সময় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এ আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং গোপনে সৈনিকদের বিয়ের কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। এর পরিণতিতে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল ও উপহার দিয়ে যেত। এক কারারক্ষীর মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। এক সময় ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে পড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভ্যালেন্টাইনের বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি তার অন্তিম চিঠিটি ছিল "Love from your velentine"। স্ত্রীর প্রতি ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা ও ভ্যালেন্টাইনের প্রতি দেশের তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার কথা চলে যায় সম্রাটের কানে। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে খ্রিষ্টীয় ২৭০ শতকের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদ- দেন। এরপর খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ১৪ ফেব্রুয়ারির এ দিনটিকে ওই পাদ্রির নামে নামকরণ করে ভালোবাসার উৎসব দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। খ্রিস্টানদের একটি ধর্মীয় উৎসব কালক্রমে রূপান্তরিত হয়েছে জৈবিক কামনা ও যৌনতার উৎসবে।
যদিও দিবসটি ছিল বিবাহিতদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি প্রয়াস; কিন্তু এখন অবিবাহিতরাই এ দিনটিকে ভালোবাসা প্রদর্শনীর উপলক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। যাদের বিবাহের সামর্থ্য আছে তারা বিবাহ-পরবর্তী ভালোবাসা গোপনে উদযাপন করতেই পারে। কিন্তু জনসমক্ষে যৌনাচারে মেতে ওঠা নিতান্তই সভ্যতার পরিপন্থি। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা দিবস উদযাপনের নামে যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুকরণ করছে তা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ও হারাম। বিবাহের আগে এরূপ প্রেম-ভালোবাসা যা ইসলামের নীতি ও আদর্শবহির্ভূত।
ভালোবাসা দিবসে মুসলমানদের করণীয় : মুসলিম ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুকরণে এ দিবস উদযাপন করে, তাদের কাছে ভালোবাসা হলো নিদারুণ যন্ত্রণা, জটিলতা, সংকট ও নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়ার নাম। তারা ভালোবাসার মানুষটিকে পোশাকের মতো পরিবর্তন করে নতুন সঙ্গীর সন্ধানে অস্থির থাকে। তাদের এ বেলেল্লাপনা পরিবর্তনের ধারা চলতে থাকে আজীবন। তাদের সংসার জীবন হলো একেকটা আগ্নেয়গিরি। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক লেলিহান শিখার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে। যে আগুনে ছারখার হয় তাদের সাজানো সব সুখ-শান্তি। তাদের সে ভালোবাসাবিহীন যন্ত্রণাকাতর জীবনে ভালোবাসার একটু উপলব্ধি সৃষ্টির জন্যই মূলত তারা তথাকথিত ভালোবাসা দিবসের উদ্ভব ঘটিয়েছে।
ইসলাম নারী-পুরুষকে পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে উভয়ের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক করেছে এবং উভয়ের দৃষ্টি অবনত রাখার বিধান রেখেছে। যেই সমাজ নারীকে অশ্লীলতায় নামিয়ে আনে, সেই সমাজ অশান্তি ও সব পাপাচারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। আর এজন্যই ইসলামে সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যে কোনো প্রকার সৌন্দর্য বা ভালোবাসার প্রদর্শনী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। নারী জাতিকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জাহেলি যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বাইরে বের হইও না।’ (সূরা আহজাব : ৩৩)।
এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে তা দেখতে চাইলে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকানোই যথেষ্ট, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হচ্ছে।
ইসলামে বেগানা নর-নারীর কোনো নির্জন স্থানে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। কারণ তাতে ব্যভিচার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ব্যভিচার করার আগ্রহ তৈরি হতে পারে এমন কাজের ধারে-কাছে যেতেও কোরআন নিষেধ করেছে। ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা ইসরা : ৩২)। ইসলামের চাওয়া হলো কোনো ব্যক্তি শুধু ব্যভিচার থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবে না, বরং এ পথে ধাবিতকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। হাদিসে এসেছে, ‘যখনই কোনো পুরুষ পরনারীর সঙ্গে নির্জনে দেখা করে তখনই শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়।’ (তিরমিজি : ২১৬৫)। আর শয়তান তাদের ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। ইসলাম বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌনাচারকে জেনা বলে গণ্য করেছে। হাদিসে এসেছে, ‘দুই চোখের জেনা হলো পরনারীর প্রতি নজর করা, দুই কানের জেনা হলো যৌন উত্তেজক কথাবার্তা শোনা, মুখের জেনা হলো পরনারীর সঙ্গে রসালো কণ্ঠে কথা বলা। হাতের জেনা হলো পরনারীকে স্পর্শ করা এবং পায়ের জেনা হলো যৌনমিলনের উদ্দেশ্যে পরনারীর কাছে গমন। অন্তরের জেনা হলো হারাম বস্তু কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ এগুলো বাস্তবায়ন করে বা মিথ্যা সাব্যস্ত করে।’ (মুসলিম : ৬৯২৫)।
ভালোবাসা দিবস উদযাপনের পরিণতি : ভালোবাসা দিবস পালনের নামে তরুণ-তরুণীরা বেহায়াপনার উৎসবে মেতে ওঠে। এর মাধ্যমে সমাজে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও ব্যভিচারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আর যেই সমাজে নির্লজ্জতা ও ব্যভিচার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- বেড়ে যায় এবং আল্লাহর কঠিন আজাব ও গজব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। একজন প্রকৃত মুসলিম নারী বা পুরুষ এ ধরনের নোংরা উদযাপনে কখনও অংশগ্রহণ করতে পারে না। যারা এ ধরনের অশ্লীলতায় নেতৃত্ব দেয় এবং অংশগ্রহণ করে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এরশাদ হয়েছে ‘যারা মোমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটায় তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা নূর :১৯)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান, তারা তার ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, যার অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দেবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ : ৪০০৯)। আজ করোনার মতো বিশ্বজুড়ে প্রাণ হরণ ও আতঙ্ক তৈরি করা মহামারিসহ নানা চিকিৎসা-অযোগ্য রোগের যে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, এসবের ক্ষেত্রে হাদিসটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
কাজেই সমাজে অবৈধ প্রেম, পরকীয়া, অশ্লীলতা, অপসংস্কৃতি চালু রেখে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা যাবে না। আর এগুলো সমাজ থেকে মূলৎপাটন করতে হলে দরকার সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়ন করা। তাছাড়া আমাদের আবহমান সুস্থ বাঙালি সংস্কৃতিও এসব অসুস্থ মেকি ভালোবাসা ও বেহায়াপনা সমর্থন করে না।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |