logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২০
বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর অন্যতম সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ শুধু স্বাধীনতাই অর্জন করেনি, বাংলা ভাষাও সম্মানিত হয়েছিল। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি তিনি যে মমত্ব ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে প্রত্যেকটি বাঙালি সাধ্যমতো আত্মনিয়োগ করুক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শুভ মুহূর্তে এটাই আমাদের অঙ্গীকার হোক
ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু
একুশে

মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। মানুষমাত্রই মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। আর তাই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিকে বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। যে ভাষায় মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশিত হয়, আবেগ-অনুরাগ ব্যক্ত হয়, দ্রোহে-সংগ্রামে মানুষ যে ভাষার সেøাগান মুখে রাজপথের মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ভাষা মানুষ ভালো না বেসে পারে না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষাও। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের মাতৃভাষা, একই সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা নয়, মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যারা পায় নিঃসন্দেহে সে জাতি ভাগ্যবান জাতি, সেই বিচারে বাঙালি সৌভাগ্যবান। কেননা বাঙালির ‘মাতৃভাষা’ আর ‘রাষ্ট্রভাষা’ দুটিই বাংলা। আমাদের ভাষা বেঁচে থাকে আমাদের লেখায়, কথায় ও পড়ায়। আর আমরা বেঁচে থাকি আমাদের ভাষায়। আমরা বড় সৌভাগ্যবান, আমাদের একটি নিজস্ব ভাষা আছে। ‘বিনা স্বদেশি ভাষা মেটে কি আশা?’ আমার দুখিনী বর্ণমালা অনেক বন্ধুর পথ বেয়ে আজ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে। ১৯৪৮-এর এক সকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। সেই থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আরেকজন মহানায়কের নামও যুক্ত হলো। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বঙ্গবন্ধু। তাকে আমরা জাতির জনক হিসেবে জানি; কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি ভাষাসৈনিক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া, তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তরুণ ছাত্র শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের একজন কর্মী ও সংগঠক। তার ভাষার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গঠিত তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা দিয়ে। আবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মকা-ে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচিতে যুক্ত থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজও করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ও সার্থক গণআন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের ভাষা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী পরিণতির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার মানুষের ভাষার অধিকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনে আরও অনেকের সঙ্গে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ বছরের তরুণ, উদ্দীপ্ত ছাত্রনেতা। এ সময় তিনি শুধু ভাষার অধিকার নয়, পূর্ববাংলার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলন ও জনমত তৈরিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। তিনি কোনো একক আন্দোলন নিয়ে থাকেননি, সব ন্যায়সঙ্গত ও পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট সব ধরনের আন্দোলনে সক্রিয় এবং নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। যার ধারাবাহিকতায় এই তরুণ ছাত্রনেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই পরবর্তীকালে (১৯৭১ সালে) রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সূর্য উদিত হয়। দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। 
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় তিনি সর্বস্তরে বাংলা চালুর এই পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমিতে শহীদ দিবস (ভাষাশহীদ দিবস) উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি কোনো ছুটির দিন ছিল না। তবুও সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে প্রখ্যাত লেখক, কবি, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। যে সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা।’ 
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বাংলা ভাষা আজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর টঘঊঝঈঙ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। আজ পৃথিবীর সব রাষ্ট্র শুধু দিবসটি পালন করছে তা নয়, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্য বাঙালির ঐতিহাসিক আত্মত্যাগকে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যতকাল লেখা হবে, পড়া হবে, বলা হবে, ততকাল বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে বারবার ফিরে ফিরে আসবেন। মহান একুশের ৬৮তম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর। বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর অন্যতম সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ শুধু স্বাধীনতাই অর্জন করেনি বাংলা ভাষাও সম্মানিত হয়েছিল। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি তিনি যে মমত্ব ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে প্রত্যেকটি বাঙালি সাধ্যমতো আত্মনিয়োগ করুক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শুভ মুহূর্তেÑ এটাই আমাদের অঙ্গীকার হোক। পৃথিবীর দেশবরেণ্য নেতারা স্বদেশের ভাষাপ্রীতি দেখে বিস্মিত হয়েছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দিত করেছেন। 
এর বহু আগেও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে চীনে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করেন। ওই আদেশে বলা হয়, দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ তিন বছর পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বাস্তবায়ন চাইতেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে এমআর মাহবুব রচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশ এ তিন ছিল বঙ্গবন্ধুর চির আরাধ্য। তিনি তার পুরোটা জীবনজুড়ে কাজে-কর্মে, চিন্তাভাবনায় এর প্রমাণ রেখে গেছেন। বিশ্বের বুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পেয়ে বাংলা ভাষাকে প্রথমবারের মতো মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে এক গৌরবের আসনে বসিয়ে দেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বিস্তারিতভাবে এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। যারা বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান, তারা গ্রন্থটি পড়তে পারেন। বঙ্গবন্ধুর সেøাগান ছিল জয় বাংলা। তিনি তার প্রতিটি বক্তব্যে জয় বাংলা বলতেন। স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের সেøাগান ছিল জয় বাংলা। এই জয় বাংলা মানে হলো বাংলাদেশের জয় হোক, জয় বাংলা মানে হলো বাংলা ভাষার জয় হোক, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জয় হোক। 

রায়হান আহমেদ তপাদার 
লেখক ও কলামিস্ট
[email protected]

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]