logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বুধবার, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২০
মা-বাবা এবং সন্তানের দ্বৈরথ
সম্পর্ক

‘চুপ কর, তুই কী বুঝিস’ এমন একটা বাক্য আমাদের পারিবারিক মহলে খুব সুলভ। আর এ বাক্য ব্যবহারের কারণে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি হয়ে যেতে থাকে। আর এ দূরত্ব পরবর্তী সময়ে এতটাই বেড়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত তা আর সামাল দেওয়া যায় না। হররোজ মা-বাবা এবং অভিভাকরা সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন, যদিও তাদের দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। তবে, এখানে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। আর তা হলো দুই প্রজন্মের দ্বন্দ্ব। মা-বাবার প্রজন্ম থেকে সন্তানের প্রজন্ম শাব্দিক অর্থেই যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। আর এ দূরত্ব প্রকৃত অর্থে বুঝতে না পেরে অভিভাবকরা যেভাবে তা সামলে নিতে চাচ্ছেন, তাতে দূরত্বটা আরও বেড়ে যাচ্ছে, বেড়ে যায় প্রতিনিয়ত।
একটা বিষয় মা-বাবাকে উপলব্ধি করতে হবে, আজকের প্রজন্ম নেতিবাচক কথা এবং তার নিজের অথবা অন্যের সমালোচনা খুব বেশি নিতে পারে না। তাই মা-বাবাকে খুব সচেতন থাকতে হবে। ‘এই বেকুব কোথাকার, তুমি একটা বোকার হাড্ডি, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’ এ ধরনের কথা শুনলে সন্তানরা খুব মুষড়ে পড়ে। তাই এমন কথা বলে সন্তানকে হতোদ্যম করা যাবে না। বলতে হবে, ‘আরে দুষ্টু, আরেকটু বুদ্ধি খাটা না। দেখবি তুই পারবি, তুই-ই পারবি।’ 
আবার সন্তানকে আমরা কখনোই চাপে ফেলে দেব না। ভালো কিছু করার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ‘তোকে এটা করতেই হবে’ এমনটা না বলে বলতে হবে ‘তুমি যদি এটা করতে পার তাহলে আমি তোমাকে একটি সুন্দর উপহার তো দেবই, আর যা যা চাইবে তাও পাবে।’ একটা কিছু করার জন্য তার কাছে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে চাপে সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাকে বরং উদ্বুদ্ধ করতে হবে ভালো কিছু করতে, আরও এগিয়ে যেতে।
সন্তানকে বাস্তবতা শেখাতে হবে। বলতে হবেÑ ‘তুমি যত বড় হচ্ছো, তোমার স্বপ্নগুলো কিন্তু দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে এমনভাবে এগুতে হবে, যেন হতাশা তোমাকে ছেয়ে ফেলতে না পারে। এটা হয়নি তো কী হয়েছে, এর চেয়ে ঢের পেছনে থেকে মানুষ আরও বড় সাফল্য নিয়ে এসেছে! তোমার জীবনেও দেখ এমনটা ঘটবে।’
সন্তান যেন সাহস পায়। মা-বাবা সবসময় সন্তানকে শুধু স্বপ্ন দেখাতেই শেখাবে না, বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশ-সমাজের হালচিত্র তার কাছে তুলে ধরবে। ইদানীং ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার কাজ অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এ নিয়ে খুব চাপের মধ্যে থাকে আমাদের সন্তানরা। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ না পেলে বাবা-মাকে এখন এজন্য সন্তানকে দোষারোপ করলে হবে না। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, তোর তো খুব ভালো প্রস্তুতি ছিল না। সারাদিন আড্ডা মেরেছিস, আর মোবাইলে সারাক্ষণ বসেছিলি। এ হলো তার ফল। দেখ অমুকের ছেলে খুব ভালো, কেমনভাবে চান্স পেয়ে গেল।’ এসব বাবা-মায়ের বচন হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, আজকের বর্তমান এই প্রজন্ম ‘তুলনা’ পছন্দ করে না। তুলনার মতো ব্যাপারগুলো তারা খুব নেতিবাচকভাবে নেয়। বরং সন্তানদের দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ানোটাই বাবা-মায়ের বড় কাজ। বলতে হবে, ‘ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিংই একমাত্র পেশা নয়, যা মানুষকে বড় করে তুলবে। তুমি বিজ্ঞানের অন্য শাখায় পড়, বিজ্ঞানী হওয়ার সুযোগটা তো তোমার রয়েই গেছে।’ অথবা ‘তুমি সাধারণ বিষয়গুলোও পড়তে পার। তখন তুমি সিভিল সার্ভিসেও যোগদান করতে পারবে।’ কিংবা বলা যায়, ‘তুমি একজন ভালো উদ্যোক্তা হও, বর্তমান সময়ে সৃজনশীলতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ হচ্ছে উদ্যোক্তা হওয়া।’ এমনি করে সন্তানের মনের সাহসকে বাড়িয়ে দিতে হবে, আর তা করতে পারেন শুধু বাবা-মা-ই।
ইদানীংকালের ব্যস্ত সময়ের জীবনে সন্তান পালনে বাবা-মাকে আরও মনোযোগী হতে হবে। আমাদের বর্তমান সমাজ, সংসার, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সন্তানদের ব্যক্তিজীবন। ২০১৭ সালের এক জরিপে বেরিয়ে এসেছে, ‘৫৩ শতাংশ শিশু-কিশোর মনে করে, মা-বাবা তাদের কথা বুঝতে পারেন না।’ (‘তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদের দেওয়া তথ্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিলিং ইউনিট, ঢাকা, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯)। এ তথ্যটি আমাদের কী বার্তা দেয়? বার্তাটি বলে, বাবা-মায়ের মধ্যে সন্তানদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের দল এখন আর শুধু সন্তানদের সময় দিতে চান না অথবা চাইলেও পারছেন না ব্যস্ততায় এবং জীবনের চাপে।
অথচ আমাদের সন্তানরা আমাদের অভিভাবকদের কাছে কী চায়। তারা চায় তাদের বাবা-মা তাদের সঙ্গে একটু সময় কাটাক, তাদের সঙ্গ দিক, তাদের পড়ালেখা করার প্রয়োজনে বাবা-মাও একটু-আধটু তাদের সঙ্গে পড়াশোনা করুক, একটু খেলুক। বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি গল্পের বই তারা আনন্দের সঙ্গে মিলে-মিশে পড়তে চায়। বাবা-মায়ের নিজেদের জীবনেরই অনেক গল্প থাকে, সন্তানরা সেগুলো শুনতে চায়। কিন্তু অনেক বাবা-মা তাদের ব্যক্তিগত সুখ এবং প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এদিকে পা বাড়াতে চান না। আমাদের বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রে আরও আরও উপার্জন করতে যতটা বাইরে কাটান, আসলে ব্যক্তিজীবনে এত উপার্জন করার প্রয়োজন নেই সন্তানদের বঞ্চিত করে। আমাদের সন্তানরা অনেক একা। তারা বাবা-মায়ের গায়ের গন্ধ নিতে চায়, তাদের স্পর্শ করতে চায়, তাদের নিয়ে একসঙ্গে একটু  হাসতে চায়, ঠাট্টা-কৌতুকে আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়। কিন্তু আমাদের অনেক অভিভাবকই হয়তো জীবনের প্রয়োজনে উল্টো পথে হাঁটেন। তাদের নিজেদের সুখ-আনন্দ, ইচ্ছা, পদ-পদবির লোভ, আরও সম্পদ বাড়ানোর প্রবণতা এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন আমাদের সন্তানদের সময় দেওয়ার মাঝে।
বাবা-মাদের ভুলে গেলে চলবে না, পরিবারই সন্তানদের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা সেই পরিবার প্রথা শিথিল করে দিচ্ছি কেন! কেন আমরা প্রতিদিন অন্তত একটা সময় পরিবারের সব সদস্য একত্রে বসে সময় কাটাতে পারি না? রাতে অন্তত সবাই একসঙ্গে একই সময়ে বসে খেতে পারি! সে সময় পরিবারের কার কী সমস্যা, আগামীকাল কার কোথায় বিশেষ কাজ আছে, কোনো কেনাকাটা আছে কি না, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়ানো অথবা বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাই মিলে যাবে কি না, কাকে কী উপলক্ষে কী উপহার পাঠানো যায় ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শগুলো সেরে ফেলা যায়। এ সময় আজ কে কী কাজ করেছি, কোথায় গিয়েছি, কী খেয়েছি সে সম্পর্কে কথা বলতে পারি। এতে পারিবারিক সম্প্রীতিও বাড়বে এবং বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্বও কমে আসবে, সবার নৈকট্য বৃদ্ধি পাবে। বাবার সঙ্গে মায়ের, মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্কও এতে দৃঢ় হবে। সন্তানদের মধ্যে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। শৈশব থেকেই তারা বুঝে উঠবে, যে কোনো কাজ সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হয়। এতে ফল ভালো হয়। সন্তানরা তাদের মনের আসল কথা খুলে বাবা-মায়ের সঙ্গে যে কোনো বিষয় যে কোনো সমস্যা শেয়ার করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। আমাদের সন্তান আমাদের জন্য দূরের মানুষ বা অপরিচিত কেউ না হয়ে কাছের মানুষ হবে।
আমাদের খেয়াল রাখত হবে, সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক কখনও যেন দ্বৈরথ তৈরি না করে এবং সে উদ্যোগটা বাবা-মায়ের থেকেই থাকতে হবে। সন্তানদের সব ব্যাপারেই বাবা-মা সতর্ক থাকবেন; কিন্তু আড়ি পাতবেন না। গোপন ক্যামেরায় সন্তানদের গতিবিধি পরখ করবেন না। সন্তানের কাছে নীতিকথা বলতে হবে; কিন্তু তার আগে বাবা-মাকেও নীতিবান হতে হবে। আর তা না হলে সন্তান তা মেনে নিতে চাইবে না। সন্তানকে আগে অন্য শিশু-কিশোরদের সঙ্গে শিখতে দিতে হবে। বাবা-মা অভিভাবক, পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও তাদের সঙ্গে মেশার; নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তবেই আমাদের সন্তানরা হবে বিকশিত এবং আনন্দে ভরপুর। বিকশিত হবে আমাদের সমাজ সুন্দরভাবে। 

পিআইডি ফিচার

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]