logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, রবিবার, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০২০
ইসলামে ভূমির পরিচয় ও প্রকারভেদ
আবদুল্লাহ মুসাফির

উর্বর ও উৎপাদনশীল ভূমি আছে যেগুলো চাষাবাদ না করার কারণে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। এরূপ ভূমি যদি কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষাবাদ করে তবে সে ওই ভূমির মালিক হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুমতির প্রয়োজন আছে। এরূপ ভূমির চাষাবাদকারী ব্যক্তিকে সরকার ভূমি স্বত্ব প্রদান করতে পারে। এ স্বত্ব তারা বংশ পরম্পরায় ভোগ করার অধিকার রাখে। এ ধরনের ভূমির মাধ্যমে ‘আরদে মাওয়াত’ নামীয় মালিকানাবিহীন ভূমিও রয়েছে। উৎপাদনের স্বার্থে এসব ভূমি সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চাষাবাদের জন্য ভূমিহীনদের 
মধ্যে বণ্টন করতে পারে। সরকারি মালিকানাধীন পশু বিচরণের জন্য সংরক্ষিত 
ভূমি সরকারি ভূমি হিসেবেই বিবেচিত হবে

 

ভূমি মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মতে, ভূমি  হতেই সব কিছুর উৎপত্তি। আবার এ ভূমিতেই সব কিছু বিলীন হয়ে যাবে। ভূমি বা জমি মানুষের মূল্যবান সম্পদ। ভূমির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সৃষ্টির শুরু থেকে সব দেশে ভূমির ব্যবহার বিদ্যমান। মানব সমাজের ক্রমবিকাশ, ভূমির চাহিদার ক্রমবিকাশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভূমি ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ভূমি শব্দের অর্থ হলো পৃথিবী, ভূ-পৃষ্ঠ, মাটি, মেঝে, ক্ষেত্র, জমি ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে মাটি বা জমির উপরিভাগকে ভূমি বলে। ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত প্রাথমিক স্তুরের ক্ষয় সাধনের ফলে যে ক্ষুদ্র কণা ভূ-পৃষ্ঠে জমা হয় এবং তার সঙ্গে জৈব পদার্থের সংমিশ্রণের ফলে যে পদার্থ গঠিত হয় তাই ভূমি বা মাটি। মৃত্তিকা বা মাটি শব্দের আরবি প্রতিশব্দ ‘তুরাব’, আর ভূ-পৃষ্ঠ শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘আল-আরদ’। ‘আরদ’ বা ভূ-পৃষ্ঠ বলতে আমরা যে গ্রহে বাস করছি তাকে বোঝায়। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছেÑ ‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার অতিক্রম কর, কিন্তু তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না ছাড়পত্র ছাড়া।’ (সূরা রহমান : ৩৩)। ভূ-পৃষ্ঠ দ্বারা বাসগৃহকে বোঝানো হয়েছে কোরআনুল কারিমে। বলা হয়েছে : ‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই তিনি তোমাদের বসতি দান করেছেন।’ (সূরা হুদ : ৬১)। কোনো কোনো আয়াতে ‘আরদুন’ শব্দটি বিস্তৃত বিছানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআন মজিদে উল্লেখ আছেÑ ‘যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তার সাহায্যে তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং তোমরা জেনেশুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করো না।’ (সূরা বাকারা : ২২)।
‘আরদুন’ শব্দটি মাটি অর্থেও কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনÑ ‘যখন তোমরা বলেছিলে, হে মুসা! আমরা একই রকম খাদ্যে কখনও ধৈর্যধারণ করব না। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করÑ যেন তিনি ভূমিজাত দ্রব্য শাক-সবজি, কাঁকুড়, গম, মসুর ও পিঁয়াজ আমাদের জন্য উৎপাদন করেন। মুসা বললেন, তোমরা কি উৎকৃষ্টতর বস্তুকে নিকৃষ্টতর বস্তুর সঙ্গে বদল করতে চাও?’ (সূরা বাকারা : ৬১)। মানব সৃষ্টির মূল উপাদান মাটি। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমের ভাষ্যÑ ‘আমি মাটি থেকেই তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে দিব এবং এ থেকেই তোমাদের আবার বের করব।’ (সূরা ত্বহা : ২২)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যার ভূমি আছে সে যেন তা চাষ করে। আর যদি সে চাষ করতে অপারগ হয় তাহলে যেন তার ভাইকে (চাষ করার জন্য) দান করে দেয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো পতিত অনাবাদি ভূমি আবাদ করবে সে নিজেই সে ভূমির মালিক হবে।’
এভাবে কোরআন ও সুন্নাহে মানব জাতিকে ভূমির সদ্ব্যবহার করে রিজিকের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার স্ফীতি কোনো কোনো দেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে বর্তমান বিশ্বের বহু দেশে চাষযোগ্য জমি অনাবাদ পড়ে আছে, যেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারলে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মানব জাতি খানিকটা হলেও মুক্তি লাভ করতে পারত।
ইসলামের ভূমি নীতি একটি বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। ইসলামের ভূমি ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ভূমির অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। ইসলাম বৈধ পন্থায় ক্রয়কৃত কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিকে ব্যক্তিমালিনাধীন জমি বলে স্বীকার করে। দেশের সব ভূমি ব্যক্তি মালিকানায় সমর্পণ না করে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে রাখার অনুমতি রয়েছে। যাতে প্রয়োজনের সময় দেশের সার্বিক কল্যাণ ও ভূমিহীন লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করা সম্ভব হয়। সরকারি মালিকানাধীন ভূমির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো। 
মালিকানাবিহীন যেসব ভূমি গ্রাম ও শহরবাসীকে সাধারণ ও যৌথ প্রয়োজনের খাতিরে ব্যবহৃত হয়। যথাÑ খাল, বিল, নদী, ঝরণা, গোচারণ ভূমি, সড়ক, পথঘাট, খেলার মাঠ, কবরস্থান ইত্যাদি। এছাড়া বন, খনি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ ভূমি ও সরকারি মালিকানায় থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ভূ-সম্পত্তি সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে এ ধরনের ভূ-সম্পত্তি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যেও বণ্টন করতে পারেন। মহানবী (সা.) খায়বরের বিজিত ভূমির অর্ধেক বণ্টন করে বাকি অর্ধেক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গ্রহণ করেন। অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে ওই ভূমি খাজনা লাভের বিনিময়ে তা পূর্বতন মালিকদেরও দিতে পারে। 
শক্রদের ছেড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত ভূ-সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত হবে। ইহুদি বনু নাজির গোত্রের ভূমি সরকারি মালিকানাধীন হয়েছিল। মালিকানাবিহীন যেসব ভূমি পতিত অবস্থায় থাকে এবং শহর বা গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় না। যেমনÑ বন-জঙ্গল, মরুভূমি, অনাবাদি পাহাড়ি জমি ইত্যাদি। এসব জমি কার্যত যেমন আবাদ ও ফসলযোগ্য নয়, তেমনি এর দ্বারা কোনো উপকারও হয় না। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় এ শ্রেণির ভূমিকে ‘আরদে মাওয়াত’ বলা হয়। এ শ্রেণির ভূমির মালিক হয় সরকার। যে ভূমির মালিকের মৃত্যু হয়েছে এবং তার কোনো উত্তরাধিকারও নেই, এমন ভূমিকে ‘আদিউল আরদ’ বলা হয়। এরূপ ভূমির মালিক হবে স্বয়ং সরকার। 
বিজিত অঞ্চলের ভূমি ‘খালিসা’ বা খাস জমি হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এর মালিকানার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। যেমন হজরত ওমর (রা.) কর্তৃক পারস্য বিজিত হলে তিনি সেখানকার সম্রাট ও তার পরিবারের অধিকারভুক্ত ভূমিকে ‘খালিসা’ হিসেবে গ্রহণ করেন। কোনো ভূমির মালিক স্বেচ্ছায় মালিকানা স্বত্ব ত্যাগ করে রাষ্ট্রের অধীনে ছেড়ে দিলে তা রাষ্ট্রের হয়ে যায়। যেমন মদিনা রাষ্ট্র গঠিত হলে চাষাবাদে অতীব কষ্টকর এমন সব শুষ্ক অনুর্বর জমি আনসাররা মহানবী (সা.)-এর হাতে তুলে দেন। তাঁকে ইচ্ছেমতো এগুলো ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়। 
সাধারণত আবাদি ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানাই চূড়ান্তভাবে বিদ্যমান থাকে। মালিক তার ইচ্ছেমতো এগুলোতে চাষাবাদ ও অন্য উৎপাদনমূলক কাজ করতে পারে। মালিকের বৈধ অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ এ ধরনের ভূমিতে হাত দিতে পারে না। ব্যক্তির মালিকানায় এরূপ উৎপাদনশীল ভূমি কী পরিমাণ থাকতে পারবে তার সীমারেখা ইসলাম বেঁধে দেয়নি। কিন্তু কোনো ব্যক্তির হাতে সাধ্যাতীত পরিমাণ ভূমি থাকলে অর্থাৎ তার মালিকানাধীন ভূমিতে চাষাবাদ করার ক্ষমতা না থাকলে এবং এর ফলে তার ওই ভূমি একটানা তিন বছর অনাবাদি পড়ে থাকলে রাষ্ট্র ওই ভূমির মালিকানার দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করে ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে বিতরণ করতে পারবে এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্গাচাষেও দিয়ে দিতে পারবে। যদিও বর্গাচাষের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত রয়েছে।
এমন সব উর্বর ও উৎপাদনশীল ভূমি আছে যেগুলো চাষাবাদ না করার কারণে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। এরূপ ভূমি যদি কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষাবাদ করে তবে সে ওই ভূমির মালিক হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুমতির প্রয়োজন আছে। এরূপ ভূমির চাষাবাদকারী ব্যক্তিকে সরকার ভূমি স্বত্ব প্রদান করতে পারে। এ স্বত্ব তারা বংশ পরম্পরায় ভোগ করার অধিকার রাখে। এ ধরনের ভূমির মাধ্যমে ‘আরদে মাওয়াত’ নামীয় মালিকানাবিহীন ভূমিও রয়েছে। উৎপাদনের স্বার্থে এসব ভূমি সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চাষাবাদের জন্য ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করতে পারে। সরকারি মালিকানাধীন পশু বিচরণের জন্য সংরক্ষিত ভূমি সরকারি ভূমি হিসেবেই বিবেচিত হবে। 
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনভূমি মানুষের কাছে মহান আল্লাহর দানস্বরূপ। এখান থেকে মানুষ বহুমুখী উপকার লাভ করে। এ ধরনের বনাঞ্চল অবশ্যই সরকারি মালিকানাধীন থাকবে। তবে বনাঞ্চল সংরক্ষণ, পরিচর্যা সর্বোপরি সম্পদ সংগ্রহের বিধি-বিধান তৈরি করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে এ ধরনের ভূমি  কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা সংগঠনকে ইজারা দেওয়া যেতে পারে। খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ ভূমি কোনোভাবেই ব্যক্তি মালিকানায় থাকতে পারে না। কারণ এর সঙ্গে দেশের জনস্বার্থ সংযুক্ত। এ ধরনের ভূমি কোনো এক ব্যক্তিকে জায়গির হিসেবে প্রদান করেও মহানবী (সা.) সর্বসাধারণের উপকারের কথা চিন্তা করে আবার তা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে ফিরিয়ে নিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। মরু ও পাহাড়ি ভূমির উৎপাদনের ক্ষমতা নেই বলে ব্যক্তিবিশেষের কাছে এর তেমন ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকে না। এ জাতীয় ভূমিতে ব্যক্তিগত স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যক্তি এ ধরনের ভূমির মালিকানা লাভ করতে পারে।
মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ কল্যাণকর ও সর্বজনীন। এতে জুলুম বা শোষণের কোনো অবকাশ নেই। সর্বোপরি ইসলামী অর্থনীতিতে মালিকানা নীতি একটি সুষম ও আদর্শিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যবস্থায় যেমন সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়, তেমনি ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতির মতো যথাক্রমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রদান করে সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয় না। মোটকথা ইসলামী আইনে ভূমিসহ যাবতীয় সম্পদের মৌলিক মালিকানা আল্লাহর এবং তার নির্দেশিত পন্থায় ভোগ ও ব্যবহারের শর্তে ব্যক্তি মালিকানাও স্বীকৃত।

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]