
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০ | |
বই। মানব সভ্যতার সবচে দামি জিনিস। ‘মানুষ’ হওয়ার সেরা মাধ্যম। ভদ্র ও সভ্য, মর্যাদাবান ও সম্মানীত হতে জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। মন মনন গঠনে, প্রতিভা বিকাশে বই অপরিহার্য। জ্ঞানার্জন হয় দুইভাবে। পড়াশোনা ও সাহচর্য। সাহচর্য হলো পাঠের আরেক রূপ। বই মানুষকে রুচিশীল করে।
বই মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। শান্তিপ্রিয় ও সভ্য মানুষেরা বইপ্রিয় হয়ে থাকেন। পৃথিবীকে শান্তি ও সুখময় করে গড়ে তুলতে বই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। পড়াশোনা, বই, জ্ঞানার্জন মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট অতি পছন্দনীয়। মানবজাতির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালার প্রথম বাণী হলো ‘পড়’। এ থেকেই বোঝা যায়, জ্ঞানার্জন ব্যতীত আল্লাহর পরিপূর্ণ প্রিয় বান্দা হওয়া যায় না। ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে বইয়ের স্থান সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন। ইসলামী জ্ঞান বিস্তারে মুসলমান মনীষী, বিজ্ঞ ইমাম ও ফকিহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির, গবেষকরা এত পরিমাণ বই-পুস্তক লিখেছেন, যার উদাহরণ অন্য কোনো ধর্মে পাওয়া যায় না।
ধর্মীয় বই-পুস্তকের আধিক্য মুসলিম জাতির ‘মুজিজা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা, সবকিছুর বিনিময়ে বইয়ের মালিকানা লাভ করার বৈচিত্র্যময় ঘটনায় ইসলামের ইতিহাস ভরপুর। সুদূর অতীত, নিকট অতীত হয়ে বর্তমান সময়েও ইসলামী মনীষীদের বইপ্রীতি ও বই ক্রয়ের আশ্চর্যজনক ঘটনা আমাদের নাড়া দেয় তুমুলভাবে। আজকের লেখায় তেমনই কিছু ঘটনার বর্ণনা থাকলো।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সব সম্পত্তি ব্যয় করে কিতাব ক্রয়!
ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.)। হানাফি মাজহাবের প্রধান প্রচারক ও অন্যতম প্রবক্তা। পৃথিবীজোড়া খ্যাত ফকিহ ও ইমাম। ইমাম আবু হানিফার প্রিয় ছাত্র। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে তার ভাগে আসে ৩০ হাজার দেরহাম। তিনি ১৫ হাজার দেরহাম ব্যয় করে আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা শাস্ত্রের কিতাব ক্রয় করেন। বাকি ১৫ হাজার দেরহাম ব্যয় করে ক্রয় করেন হাদিস ও ফতোয়া শাস্ত্রের বই-পুস্তক! বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সমুদয় সম্পদ বই কেনার পেছনে ব্যয় করে ফেলেন!
শরীরের জামা বেচে বই ক্রয়!
ইমাম আহমদ আন নাজ্জার (রহ.)। হিজরি তের শতকের বিস্ময়ভরা মেধা ও ইলমের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকাংশ শাখায় তার প্রবাদ প্রতীম জ্ঞান ছিল। কিতাব সংগ্রহে তার আগ্রহ দৃষ্টান্তযোগ্য। দোকানে একটি কিতাব দেখে খুব পছন্দ হলো। অথচ তার কাছে কোনো অর্থ নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি শরীরের জামা খুলে উদোম হয়ে গেলেন, ওই জামা বিক্রয় করে উল্লিখিত কিতাবটি ক্রয় করে তারপর বাড়িতে ফেরেন! মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মূল্য দাঁড়িয়েছিল ৪০ হাজার দিনার!
এক হাতে বাড়ি দিলেন অন্য হাতে কিতাব নিলেন!
ইমাম ইবনে খাশশাব (রহ.)। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক, ভাষাবিজ্ঞানী, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির। কিতাব সংগ্রহের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। কোনো কিতাব বিক্রয় হবে শুনলে বা কোনো আলেম মারা গেলে তার সব কিতাব তিনি ক্রয় করে নিতেন। এভাবে অত্র অঞ্চলের সব আলেমের কিতাব এক সময় তার সংগ্রহে চলে আসে।
একবার তিনি ৫০০ দিনার মূল্যে কিছু কিতাব ক্রয় করেন। অথচ তার নিকট তখন কোনো অর্থ নেই। তিনি বিক্রেতার নিকট তিন দিন সময় চাইলেন। তিন দিন পর বিক্রেতাকে ডেকে নিজের বাড়ির দরদাম করতে বললেন। কিতাব বিক্রেতা ইবনে খাশশাবের বাড়ির দাম নির্ধারণ করলেন ৫০০ দিনার! ফলে ইবনে খাশশাবের বাড়ি চলে গেল কিতাব বিক্রেতার মালিকানায়, আর ইবনে খাশশাব পেলেন শুধু কিতাব! শেষ বয়সে তিনি লোকজনকে সাক্ষী রেখে তার সব কিতাব সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফ করে যান।
ঘরের আসবাবপত্র বিক্রয় করে কিতাব ক্রয়!
ইমাম আবদুল হক সিকিল্লি (রহ.)। প্রখ্যাত মনীষী, আলেম ও গবেষক। নিজ শহরে একদিন তিনি ইমাম আবুল কাসেম বারানি লিখিত ‘তাকরিব’ কিতাবের একটি কপি দেখলেন। কিতাবের বিষয়বস্তু ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা তাকে খুব আকর্ষণ করল। কিতাবটি ক্রয়ের ইচ্ছে করলেন, কিন্তু তার কাছে কোনো অর্থ ছিল না। বাজার থেকে তিনি বাড়ি ফিরে এসে ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র বিক্রয় করে, বিক্রয়লব্ধ মূল্য দিয়ে ওই কিতাবটি ক্রয় করে ফেলেন!
দেনা শোধ!
ইমাম ইবনে জুরাইস (রহ.)। হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত আলেম। তিনি সর্বশেষ বসরায় আগমন করেন কাগজ ব্যবসায়ীদের দেনা পরিশোধের জন্য। দেনা ছিল ১০ হাজার দেরহাম! কত কিতাব তিনি ক্রয় করেছিলেন, দেনা পরিশোধের পরিমাণ থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়!
কিতাবের শোকে দুই মাস কথা বন্ধ!
ইমাম আবু আলী আল ফারিস (রহ.)। বিশ্ববিখ্যাত আরব সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী। তৎকালীন জ্ঞানের শহর বাগদাদে আগুন লেগে পুড়ে যায়। আগুনের ভয়াবহতার ফলে পাশের শহর বসরায়ও জ্ঞান চর্চা সীমিত হয়ে পড়ে। তিনি নিজের হস্তলিপি নোট দেখে ছাত্রদের পাঠদান করতেন। আগুন নিভে যাওয়ার পর তিনি কিতাবের বিভিন্ন সেলফ ও সিন্দুকে রক্ষিত বইপুস্তক খুঁজতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইমাম মুহম্মাদ (রহ.)-এর ‘কিতাবুত তালাক’ ব্যতীত অন্য কোনো কিতাব উদ্ধার করতে সক্ষম হননি।
আল ফারিসের ছাত্র উসামান ইবনে জিন বলেন, আমি উস্তাদ আল ফারিসকে সান্ত¦না ও প্রবোধ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমার দিকে বড় আশ্চর্য ও করুণাভরে তাকিয়ে বললেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া বইয়ের শোক ও পেরেশানিতে দুই মাস যাবত কারও সঙ্গে কথা বলিনি! শোক কাটাতে বাগদাদ থেকে বসরায় চলে এসেছি। অনেকদিন যাবত বিষণœ ও দুশ্চিন্তায় এখানে দিনাতিপাত করছি!
# তৎকালীন দিনার-দেরহামের সঙ্গে বর্তমান টাকার বাজারমূল্য বিবেচনা করলে কোটির অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে।
(তথ্য সূত্র : আরববিশ্বের বিখ্যাত গবেষক, আলেম, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও চিন্তাবিদ শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) লিখিত ‘সাফহাতুম মিন সবরিল উলামা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।)
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |