
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০ | |
জীবন-মৃত্যু আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি বান্দাকে পরীক্ষাস্বরূপ সুুস্থতা-অসুস্থতা, আনন্দ-বেদনা ও সুখ-দুঃখ দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ‘পুণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমতাময়।’ (সূরা মুলক : ১-২)।
মানব জীবনে অসুস্থতা আল্লাহর এক বিধান। তিনি যাকে ইচ্ছা অসুস্থ করেন, যাকে ইচ্ছা সুস্থতা দান করেন। তিনি সব রোগ, তার কারণ, ধরন ও উৎস সম্পর্কে অবগত। তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা ক্বামার : ৪৯)। আর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখ, যা তোমাকে অতিক্রম করে চলে গেছে তা কখনোই তোমাকে আক্রান্ত করার জন্য ছিল না, আর যা তোমাকে আক্রান্ত করেছে তা কখনই তোমাকে অতিক্রম করার ছিল না।’
আল্লাহ তায়ালাই উপকার ও অপকারের মালিক। তিনিই দানকারী ও বারণকারী। একমাত্র তাঁর হাতেই রোগ ও আরোগ্য দানের ক্ষমতা। তিনি ইবরাহিম (আ.) এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘যখন আমি রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন।’ (সূরা শো‘আরা : ৮০)। আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে তার হিকমত। অন্যদিকে এতে রয়েছে নেয়ামত। কেননা রাত নামলেই দিনের মূল্য বুঝে আসে। তেমনি অসুস্থ হলেই সুস্থতার মর্যাদা বুঝা যায়। মানুষ, তার মর্যাদা যাই হোক না কেন, সে যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, সে অসুস্থ হবেই। সর্বশ্রেষ্ট মানব নবীরাও অসুস্থ হয়েছেন। ডাক্তাররাও অসুস্থতার হাত থেকে রেহায় পাননি। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে রাসুল (সা.) থেকে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে আমি আর কাউকে দেখিনি।’ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.) এর কাছে গিয়ে দেখি তিনি তীব্র জ্বরে মাটিতে গড়াগড়ি করছেন।’
আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়া ও রহমত যে, তিনি সব রোগের প্রতিকার সৃষ্টি করেছেন, যারা জানার তারা জেনেছে, আর অনেকেই অজ্ঞতায় রয়ে গেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব রোগেরই প্রতিষেধক রয়েছে।’ শরীরের চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে সব ধরনের ঔষধকে মানুষের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন। তাই তো পানিতে, খাবারে, জমিনের উদ্ভিদে এমনকি সৃষ্টিজীবের বিষের মধ্যেও ঔষধ রয়েছে। বরং বলা যায়, সবখানে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের দুর্বলতা, তাদের প্রয়োজনীয়তা ও অভাব বিবেচনায় দয়া করে সব কিছু সহজ করে দিয়েছেন।
ইসলাম চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে। শরয়ি জ্ঞানের পর চিকিৎসা বিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান বলে ঘোষণা করে। কেননা এর মাধ্যমে মানব জীবন রক্ষা পায়, রোগ থেকে আরোগ্য লাভ হয়। ইমাম শাফি (রহ.) বলেন, ‘ইলম দুই প্রকার, দ্বীনি ও দুনিয়াবী। দ্বীনি ইলমের নাম ইসলামি শরিয়াহ। আর দুনিয়াবী ইলম হলো চিকিৎসা। তিনি আরও বলেন, ‘হালাল-হারামের জ্ঞানের পর চিকিৎসাবিদ্যার চেয়ে মহৎ কোনো জ্ঞানের কথা আমার জানা নেই।’
চিকিৎসাবিজ্ঞান ও তার উপকরণের উন্নতি সাধনে মানবজাতি তার সবটুকু ব্যয় করা সত্ত্বেও তারা অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা প্রদানে অক্ষম। মানুষের অক্ষমতা আরও প্রকাশ পায় যখন তাদের জীবনে পৃথিবীর তুচ্ছ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে। তা তাদের শরীরকে গ্রাস করে দেয় এবং ধ্বংসাত্মক ব্যাধি ও মহামারির বিস্তারের কারণ হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সবাই একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।’ (সূরা হজ : ৭৩)।
মানুষ অনেক শক্তিশালী ও প্রভাবক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন মহামারির হঠাৎ আবির্ভাব এবং অনেক মাখলুক তাতে আক্রান্ত ও নিঃশেষ হয়ে যাওয়া তার দুর্বলতা, স্বল্পবিদ্যা ও সীমিত শক্তির বিষয়টিকে জোরালো করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বোঝা হালকা করতে চান। মানুষ দুর্বল সৃজিত হয়েছে।’ (সূরা নিসা : ২৮)। এ বিষয়টি মূলত তার হৃদয়ের প্রশান্তির দিকে আহ্বান করে। এবং তাওবা ও ফিরে আসার মাধ্যমে স্রষ্টার নিকট অবনত ও বিনয়ী হতে শেখায়।
প্লেগ, মহামারি ও ভাইরাসের বিস্তার বা সংক্রমণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আল্লাহর ওপর ভরসার দাবি রাখে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তাঁর কাছে দোয়া করা, যথাসাধ্য চেষ্টা করা এবং এ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি তোমরা কোথাও মহামারির কথা শুনতে পাও তাহলে সেখানে গমন থেকে বিরত থাক। আর যদি আক্রান্ত স্থানে তোমরা অবস্থান করে থাক তাহলে সেখান থেকে চলে যাবে না।’
মহামারি ও ভাইরাসের সংক্রমণে মোমিন মূলত আল্লাহ তায়ালার বিচার ও তাকদিরের ওপর বিশ্বাসী হয়। তার পালনকর্তার প্রতি সুধারণা পোষণ করে। স্রষ্টার সঙ্গে সদাচারি হয় এবং শিষ্টাচার প্রদর্শন করে। বিরক্ত, অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হয় না। বরং ধৈর্যের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। এবং অসুস্থতায় পালনকর্তার দান-অনুদান আর মহান অনুগ্রহ উপলব্ধি করে। রাসুল (সা.) একবার উম্মে সায়েব বা মুসাইয়েবের নিকট গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি হয়েছে হে উম্মে সায়েব? গোঙ্গাচ্ছ কেন?’ তিনি বললেন, জ্বর হয়েছে। আল্লাহ যেন এর মধ্যে বরকত না দেন। তখন রাসুল (স.) বলেন, ‘জ্বরকে গালি দিও না। কেননা হাপর যেভাবে লোহার ময়লা দূর করে দেয় তেমনি তা মানুষের গুনাহ দূর করে দেয়। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো মুসলমান দুঃখ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা, ব্যথা-বেদনা এমনকি কাঁটা বিঁধায় আক্রান্ত হলে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো মোমিন আর্থিক, শারীরিক বা সন্তান-সন্ততির ক্ষেত্রে বিপদে আক্রান্ত হলে সে তার কারণে আল্লাহ তায়ালার নিকট গুনাহমুক্ত হয়ে সাক্ষাৎ করবে।’
রোগব্যাধি আল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি আপনার পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতিও পয়গম্বর প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর আমি তাদের অভাব-অনটন ও রোগব্যাধি দ্বারা পাকড়াও করেছিলাম যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে।’ (সূরা আনআন : ৪২)। কত ব্যাধিই না আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য কল্যাণের ধারা খুলে দিয়েছে। তার মুখে আল্লাহর জিকির, হামদ আর তাসবিহ তুলে দিয়েছে। রোগ ব্যক্তিকে অহংকার ও গর্ব থেকে পবিত্র করে। হৃদয়কে কোমল করে দেয়। স্রষ্টার জন্য বিনয়, নম্রতায় হৃদয়টা ভরে ওঠে। দুনিয়ার পরীক্ষা, মুসিবত যদি না থাকত তাহলে বান্দা অহংকার, তাকাব্বুরি আর কঠিন হৃদয়ের ব্যাধিতে আক্রান্ত হতো, যা তাকে ধ্বংস করে দিত।
এমন নেয়ামত যা বান্দাকে আল্লাহর জিকির ভুলিয়ে দেবে তা থেকে মুসিবত ও সমস্যা অনেক ভালো, যা বান্দাকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে। মুসলিম যখন দেখে কোনো বিপদ, মহামারি বা প্লেগ জাতীয় ব্যাধি ব্যক্তি-সমাজকে গ্রাস করছে তখন সে আল্লাহ তায়ালার কাছে তা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে। সুরক্ষায় প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো আক্রান্তকে দেখবে অতঃপর বলবে, ‘সব প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি তোমাকে যে রোগে আক্রান্ত করেছেন তা থেকে আমাকে মুক্ত রেখেছেন এবং আমাকে অনেক সৃষ্টি থেকে সম্মানিত ও প্রধান্য দিয়েছেন, তাহলে তাকে সে ব্যাধি গ্রাস করবে না।’ অন্যত্র রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা ও রোগমুক্তি চাও এবং শুরু ও শেষের বিশ্বাস চাও।’
মানব সমাজের সার্বিক অবস্থার বির্বতন এবং পার্থিব জীবনের দুর্বিষহ অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তা করলে একজন মুসলিম স্থায়ী নেয়ামত ও জান্নাতের প্রতিদানের বিষয়টি অনুভব করতে পারবে। যেখানে কোনো রোগব্যাধি নেই, দুশ্চিন্তা ও বিপদাপদ নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ঘোষক ঘোষণা দেবে, ‘তোমরা সুস্থ, আজ থেকে আর কখনও অসুস্থ হবে না। তোমরা আজ থেকে চিরঞ্জীব, আর কখনও মৃত্যুবরণ করবে না। তোমরা চির তরুণ, আর কখনও বৃদ্ধ হবে না। তোমরা নেয়ামত ভোগ কর, আর কখনও তোমরা নিঃস্ব হবে না।’ এটা যেন আল্লাহ তায়ালার বাণীকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ‘তাদের অন্তরে যা কিছু দুঃখ ছিল, আমি তা বের করে দেব। তাদের তলদেশ দিয়ে নির্ঝরণী প্রবাহিত হবে। তারা বলবে : আল্লাহর শোকর, যিনি আমাদের এ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। আমরা কখনও পথ পেতাম না, যদি আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন না করতেন। আমাদের প্রতিপালকের রাসুল আমাদের কাছে সত্যকথা নিয়ে এসেছিলেন। আওয়াজ আসবে : এটি জান্নাত। তোমরা এর উত্তরাধিকারী হলে তোমাদের কর্মের প্রতিদানে।’ (সূরা আরাফ : ৪৩)।
২০ জমাদিউস সানি ১৪৪১ হিজরি মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত খুতবার সংক্ষিপ্ত
অনুবাদ মুহিউদ্দীন ফারুকী
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |