logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০
সামাজিক সুরক্ষা
ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে প্রশংসনীয় উদ্যোগ
ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে
ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী

মানুষের আয়ের পথ হতে পারে নানাবিধ। তবে সব আয়ের পথ সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত আয়ের পথ মানুষের জন্য ঘৃণিত। সব ধর্মে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কবির কথায়  ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত করো সবে।’
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভিক্ষাবৃত্তি মোটেও সম্মানজনক পেশা নয়। তবে কিছু মানুষ ভিক্ষাকে আয়ের পথ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। কখনও পয়সা রোজগারের সহজ পথ হিসেবে অথবা নিতান্তই বাধ্য হয়ে। মানুষ সমস্যায় পড়ে ভিক্ষা করে একথা সত্য, তবে আমাদের দেশে ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে নিতে অনেকে আগ্রহী হওয়ার পেছনে যে বড় কারণ তা হলো এতে সহজ আয়ের ব্যবস্থা করা যায়। ভিক্ষাবৃত্তি গ্রাম থেকে শুরু করে শহর অঞ্চল পর্যন্ত চলে এ পেশা। 
সমাজে ভিক্ষা নিন্দনীয় কাজ। বিশেষভাবে শহর এলাকায় অলিগলিতে হাজার হাজার ভিক্ষুকের সকাল থেকে রাত অবধি বিচরণ সবার চোখে পড়ে। নিজেরা এ দৃশ্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হলেও যখন বিদেশি কারও সামনে এমন দৃশ্য ধরা পড়ে, তারা বেশ কৌতূহলবশত এ দৃশ্য উপভোগ করে এবং আমাদের গরিব জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে, যা সমগ্র দেশের জন্য লজ্জাকর। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এরা বিদেশিদের কাছে। তাই সবাইকে ভিক্ষাবৃত্তি  বন্ধ ও ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসতে হবে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও অধিক অর্থের আশায় এরা এ পেশা ছাড়তে নারাজ। তাই তিনি দ্রুততম সময়ে আরও সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে বর্তমান সরকারের নেওয়া ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’, প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। বিগত বছরে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি বিশেষভাবে বলব, এই ভিক্ষাবৃত্তি যেন কেউ করতে না পারে। ভিক্ষাবৃত্তিটা যেন কিছু লোকের পেশা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের আবার সর্দার থাকে। যা পায় তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে। যতই পুনর্বাসন করি না কেন, আবার তাদের ফেরত নিয়ে আসে।’ 
প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্যে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হচ্ছে ভিক্ষুকের সর্দার। যারা ভিক্ষুকের আয়ের একটি বড় অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে। এরা গ্রাম থেকে ভিক্ষুকদের শহরে এনে সহজে আয়ের পথ দেখায়। আর দিনে দিনে অলস মানুষ এ পথ বেছে নিয়ে বিনা পুঁজির ভালো ব্যবসা হিসেবে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সর্দারদের পরামর্শে এরা অভিনব উপায়ে ভিক্ষাবৃত্তি  করে থাকে যা সহজে সবার দৃষ্টি কাড়তে পারে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিলÑ  বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য ও আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। বর্তমান সরকার সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার গৃহহীনদের বিনা খরচে বাসস্থান, জীবন-জীবিকার জন্য ট্রেনিং, ঋণ প্রদান, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেনÑ ‘যে যেভাবে পারে, কাজ করে খাবে। বাংলাদেশ তখনই উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে, যখন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।’
ভিক্ষাবৃত্তি দূর করতে প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে রেলস্টেশনে, ফুটপাতে বা যত্রতত্র যারা কোনোভাবে দিনাতিপাত করে তাদের নিজেদের এলাকায় ঘরবাড়ি করে দিতে এবং প্রয়োজনে ছয় মাস বিনা পয়সায় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহসহ পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অন্যদের তার মতো একই মনোবৃত্তি  নিয়ে নিজেকে জনগণের একজন সেবক হিসেবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা যদি সবাই যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসি তাহলে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশে এক বিপ্লব সাধিত হবে। শহরে বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে, এখানে সেখানে আর ভিক্ষুকের দেখা মিলবে না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় জেলা প্রশাসকদের এ বিষয়ে বর্তমান উদ্যোগ এখন সচরাচর চোখে পড়ে। এরই মধ্যে সঠিক দিকনির্দেশনায় খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর এলাকায় জেলা প্রশাসকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভিক্ষুকমুক্ত করায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের এ ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সব জেলার জেলা প্রশাসকও ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি  দূরীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সরকারের নির্দেশে এ সব ভিক্ষুককে বিশেষ ব্যবস্থায় যাতে দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে নিতে সমর্থ হয় সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। এতে একদিকে যেমন অসহায় গরিব মানুষের দু’মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে তেমনি ভিক্ষুকমুক্ত সুন্দর পরিবেশ আমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। আশা করা যায়, অল্পদিনের মধ্যে দেশের ব্যস্ত নগরীর আরও অনেক এলাকা এভাবে ভিক্ষুকমুক্ত হবে এবং গরিব অসহায় মানুষ একটু আশ্রয়স্থলসহ দু’মুঠো খাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। সরকারের এ উদ্যোগ সবার কাছে আজ প্রশংসার দাবিদার।
সম্প্রতি ঢাকা শহরের মেয়রদ্বয় ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ভিক্ষুকবিহীন ঢাকা শহর আমাদের মতো বিদেশিদের কাছেও বিশেষভাবে প্রশংসিত হবে। যেখানে ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০.০ শতাংশ, তা ২০১৮ সালে ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকার ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্য ১২.৩০ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। চাই সবার অংশগ্রহণ, যা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। একজন সুনাগরিক হিসেবে এসব দায়িত্ব নিতে আমরা সবাই দেশ ও জাতির কাছে দায়বদ্ধ। তাই নিজের অর্জনের পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভার বহনে অংশীদার হওয়া আবশ্যক। একজন সুনাগরিক সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে এমনটি ভেবে বসে থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে না, দায়িত্ব সবাইকে সম্মিলিতভাবে নিতে হবে।
দেশে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো অসম্মানজনক পেশা থেকে মানুষকে নিবৃত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হলেও তা তেমন ব্যাপকতা পায়নি। বর্তমান জনবান্ধব সরকার ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূলের বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। বিষয়টি বিবেচনায় এনেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম বারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নিমিত্তে অর্থ প্রেরণ করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের ৫৮টি জেলায় ২ লাখ ৩ হাজার ৫২৮ ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। 
পুনর্বাসনের পাশাপাশি সরদারদের দৌরাত্ম্যের সমাপ্তি ঘটানো আজ সময়ের দাবি। এ কাজে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিশেষ ভূমিকা থাকতে হবে, এখনই শক্ত হাতে দমন করা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব, যাতে কোনোভাবেই এরা অসহায় গরিব মানুষকে দিয়ে এ আয়ের পথে পা না বাড়ায়। তা হলেই ভিক্ষাবৃত্তি  বন্ধ ও পুনর্বাসনের নির্দেশ আলোর পথ দেখবে। উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের স্থান সমুন্নত হবে। 

পিআইডি ফিচার

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]