logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০
বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২৬ মার্চ ভাষার জন্য স্মারক হয়েছে। আমরা মুক্তি চাই। মহামুক্তির পথ ধরে সে মুক্তি হবে, রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনীতির মুক্তি এবং আমাদের সংস্কৃতির মুক্তি কিংবা চেতনার শুদ্ধি মুক্তি। ভাষাকে বেয়ে আমরা জয় করতে চাই। আমাদের জয় হবে বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে। তবে সব জয়ের মূলমন্ত্র হবে ভাষার জয়। সে ভাষা আমার বাংলা ভাষার জয়, সে জয় আমাদের বাঙালির ভাষার জয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জয়
গৌতম কুমার রায়

যার প্রাণ আছে তার ভাষা আছে। যার ভাষা থাকে তার আশা আছে। সে তার ভাষা দিয়ে নিজেকে জানাতে এবং অপরকে জানতে পারে। প্রাণীমাত্রই মনে গ্রোথিত শব্দ দিয়ে বা বুলি আওড়িয়ে সুখী হতে চায়। সে ভাষা অন্য কেউ বুঝে, কেউ বুঝে না। ভাষার বুৎপত্তিগত অর্থ হলো অর্থযুক্ত কথকতা। উক্তি, অভিব্যক্তি বা সংকেতাদি। শাব্দিক বিচ্ছেদের ভাষা হলো, ভাষ্্ (কথা বলা)+অ-ভাব+আপ্। মনের ভাব প্রকাশের শব্দ ভাষা। এ ভাষা আবার দুই ধরনের। প্রথমত, স্ফুট। অর্থাৎ বিকশিত, স্পষ্ট, বিশদ, প্রদীপ্ত, নিশ্চিত। দ্বিতীয়ত, অস্ফুট। অবিকশিত, অস্পষ্ট, বিশদ নয়, অপ্রদীপ্ত এবং অনিশ্চিত। স্ফুট মানুষের ভাষা। অস্ফুট ইতর প্রাণীর ভাষা। এরপরও নীরব, নিথরে আরও কিছু প্রাণী তাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, যা আমরা অনুভূতিতে আনতে পারি না। তা হলো গাছের ভাষা, মাছ, পাখ-পাখালির ভাষা, কীট-পতঙ্গের ভাষা। প্রাণীমাত্রই স্বগোত্রে তার ভাষা সংক্রামক হয়ে থাকে। আবার তাদের অভিব্যক্তিকতা আছে। অর্থাৎ তাদের ভাষা আছে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী নিঃশেষ হওয়ার আগে নিজে জন্ম দিয়ে বংশ রেখে যেতে চায়। সে মানুষই হোক বা অন্য কোনো প্রাণীই হোক।
ভাষা দিয়ে, ভাষা বেয়ে শব্দ রূপায়িত হয়। এ রূপায়িত শব্দকে বাহিত করে আমরা আমাদের কথা, আমাদের লেখাপড়া-শোনা, শ্রদ্ধা-সম্মানবোধ এমনকি আমাদের ঘাত এবং প্রতিঘাত সংঘটিত হয়। আমার ভাষা যদি  প্রাঞ্জল না হয়, বোধগম্য না হয়, তবে আমি আর বধির অবশ্যই ভিন্ন নয়। জাতির ভাষার দাবি জীবনের দাবি। যে কারণে ভাষার উন্নয়নে জীবনের উন্নয়ন হয়। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে মনন প্রেমের এক দুর্লভ অনুভূতি। আমরা বলতে পারি, ভাষা আমাদের প্রীতি, প্রেম, আন্দোলন এবং জাগরণও বটে। তেমনি ভাষাকে নিয়ে আমাদের যে আন্দোলন তা জাগরণ ও প্রসারণে বাঙালির কাছে শহীদের জন্য স্মৃতি স্মরণে বিষয়টি আত্মোৎসর্গের জন্য শ্রদ্ধা ও মহিমার। নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতিকারের এবং সাহস ও ঐক্যের। জাতীয় পরিচয়ে আত্মপর্যবেক্ষণের। নির্বিচারে হত্যার জন্য শোকের, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় অবাধ্য প্রতিরোধের।
যে জন্ম দেয় সে মমতাময়ী মা। প্রকৃতি মাকে জন্ম দেয়। মা প্রকৃতিযুক্ত হয়ে জন্ম দেয় আমাকে। প্রকৃতি ভাষাকে জন্ম দেয়, আমি প্রকৃতি থেকে শিখি ভাষাকে। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের ভাষা আছে। এ ভাষার সংখ্যা ৭ হাজার ১০২টি। তবে এ ভাষা শুধুই স্ফুট ভাষা। এরপরও প্রকৃতি তার সৃষ্টিকে ভাষা দিয়েছে। যারা এ ভাষা দিয়ে নিজেকে চিনতে এবং চেনাতে সাহায্য করে।
মায়ের ভাষা মাতৃভাষা। প্রকৃতিগতভাবে এ ভাষা প্রাণীমাত্র মানুষের মধ্যে আসে। বাঙালির বাংলা ভাষা সে কারণে তার জন্মগত অধিকার। আমাদের প্রাণের ভাষার মধ্যে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে সংস্কৃতি, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু ভাষা যেন জাপটে ধরে চলেছে। এ রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সময় প্রবাহিত হচ্ছে প্রচুর। আমরা আমাদের ভাষাকে চিনতে, জানতে, গবেষণা করতে, সময় মন্থর করতে প্রকারান্তে বাধ্য হয়ে আছি। যে কারণে ’৪৮ থেকে ’৫২ এ সময়ে এ ভাষার জন্য লড়তে বাধ্য হয়েছি। ভাষার লড়াইটা আমাদের জন্য ছিল অপরিহার্যÑ এর শোষকদের জন্য তা ছিল সম্মানের বিষয়। সে সময়ে এদেশের ৫৬ শতাংশ বাঙালির সমর্থনকে এড়িয়ে ’৪৮ সালে জিন্নাহর দাম্ভিকতার জবাবে ‘না’ প্রত্যুত্তর দিয়ে ভাষা অধিকার যেভাবে সূচনা হয়েছিল তার পরিণতি নামে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। ’৪৮ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে জনতার ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নেয়। যার বিস্ফোরণ ঘটে ’৫২ তে। পাকিস্তানি শাসকদের অভিসন্ধি ছিল ভাষাকে দাবিয়ে তারা বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যকে শোষণ করবে। তাদের দাবিয়ে রাখবে। কেননা ভাষাগত ঐতিহ্য বিলুপ্ত করা গেলে বাঙালির গর্ব আর গৌরবের কিছুই থাকবে না। তবে বাঙালি কখনও ভাষা নিয়ে বিশৃঙ্খল এ দাসত্ব মেনে নেয়নি। যে কারণে তারা ভাষা রক্ষায় ভিন ভাষা আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অবশেষে জীবন ও রক্ত দিয়ে শাসকদের অপ-ইচ্ছার পতন ঘটায় এবং তাদের আশার গুড়ে দুরাশার বালি মিশিয়ে দেয়। এখানে যখন বাঙালির জয় হয়, তখন বাঙালি দেখা পায় আরেক স্বপ্নের। তা হলো দাসত্ব মুক্তির স্বপ্নের, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন। নিজেদের জন্য এক টুকরো জমিন লাভের স্বপ্ন। 
ভাষা সবসময় আশা জাগায়। ভাষাই মহামুক্তির মহাপথ। নিজস্ব ভাষা ছাড়া জাতি বিবেকহীন, গন্তব্যহীন। মিশরের ‘কপটিক’ ভাষার ইতিহাস বড় নির্মম। আরবদের জোর এবং বাধ্যবাদকতার কারণে যেটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। মিশরে আজ এই ভাষাটা মৃত হয়ে গেছে। সেখানে জেঁকে বসেছে আরবি ভাষা। একবার ভাবলে বোঝা যায়, আমাদের জীবনে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি না এলে, এখানে শহীদদের রক্তের বুনিয়াদ সুদৃঢ় না হলে, আমরাও স্বকিয়তা হারিয়ে অবলম্বন করতাম উর্দুকে। যেটি কিনা থাকত এক কলঙ্কের দলিল হয়ে। গঙ্গা হয়ে পদ্মা, গঙ্গা বেয়ে মেঘনা কিংবা বুড়িগঙ্গা অথবা বহ্মপুত্র জলধারায় আমার বাংলা। গারো পাহাড়ের ছায়া ছুঁয়ে যে বাংলা, সুন্দরবনের মায়া জড়ানো আমার যে বাংলা, তাকে রক্ষার জন্য যদি শহীদেরা রক্তের সোনালি আগুন না জ্বালাতেন তবে আমি কীভাবে বলতাম, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ 
আমাদের ভাষা আন্দোলন বাঙালির ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে অগ্নিঝরা আস্ফালন নয়। এটা এখন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর মর্যাদার উপাদান। এদেশের বাঙালিদের আত্মত্যাগের যে মহিমা। যে রক্তের ঋণ। তা উদার, শ্রদ্ধার এবং ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যের বিষয় বটে। যে জন্য দুনিয়ার সব মানুষ এই ঐতিহ্যের কাছে শ্রদ্ধায় সমীহিত। 
আমাদের ভাষা আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক ভাবধারার বিকাশ ঘটিয়েছিল। যেজন্য এ সফলতাকে পুঁজি করে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের গতিপথের কোনো স্থবিরতা ছিল না। হাতেগোনা কিছু কুলাঙ্গার বাদে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন, রক্ত, সম্ভ্রমের বিসর্জন দিতে সবাই ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক। ভাষার সাফল্য আমাদের আশা জুগিয়েছে আরও প্রাপ্তির। আরও প্রত্যাশার। যদি সংস্কৃতির কথা বলি, ’৫২কে ধারণ করে সে সময় থেকে প্রচুর দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন, পোস্টার, সংগীত, নাটক, সিনেমা, পত্র-পত্রিকা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সুর-বাজনা উদ্বেলিত হওয়ার চেতনা জাগ্রত হয়েছে। অর্থনীতিতে সে সময় পশ্চিমাদের আয়ত্তের ব্যবসায় যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিবর্তে বাঙালিরা স্থান করেছে, বিশেষ করে দেশ স্বাধীনের পরে। আজ শিল্প কারখানার মালিক বনেছে বাঙালিরা। অফিস-আদালতে বাঙালিরা চেয়ার নিতে পেরেছে। কিন্তু আজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি স্বাধীনতার মূল চেতনা। এখনও সাম্প্রদায়িক শক্তি হিন্দু পাড়ায় আগুন ধরিয়ে, যশোরে জেলেপাড়ায় মা-মেয়েকে ধর্ষণ করে ধর্মীয় উন্মাদনা দেখায়। বৌদ্ধ মন্দিরগুলো নিরাপত্তায় আসে রাত জেগে পাহারা দিয়ে। খ্রিষ্টান যাজকের কিংবা হিন্দু পুরোহিতের লাশ হয় মৌলবাদীদের ধর্মীয় উপকরণ। মসজিদে জঙ্গিবাদের বোমা ফাটানো হয়। দুর্নীতি আজও মহামারি এক ভাইরাস। ২২ থেকে ২২ হাজার পেরিয়ে ২২ লাখেরও বেশি কোটিপতি তৈরি হয় দেশে। কীভাবে, কে, কখন, কত টাকার মালিক হলো, সম্পদ অথবা অর্থ আয়ের উৎসই বা কি? দেশের টাকা বাইরে পাচার করে। তাতে কোনো জবাবদিহিতা নেই। আমরা বাংলা নিয়ে গবেষকদের গবেষণা চাই। আমাদের জাতীয় উন্নয়নের সোপান হোক ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার চেতনামন্ত্রে উচ্চারিত নীতি ও নৈতিকতার আলোকে।  
রাজনীতিতে ভাষা আছে, দুর্নীতিতে ভাষা এসেছে। সংগ্রামে ভাষা আছে, জীবনের জন্য ভাষা আছে। ভাষা কখনও সামনে এগোয়, ভাষা আবার পেছনেও নেয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা দিয়েছে। দিয়েছে শৃঙ্খলতা। ভাষার জন্য আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। ভাষার কারণে আমাদের কাছে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক হয়েছে ঐতিহ্যে। ভাষার কারণে শহীদের রক্ত এত পবিত্র হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২৬ মার্চ ভাষার জন্য স্মারক হয়েছে। আমরা মুক্তি চাই। মহামুক্তির পথ ধরে সে মুক্তি হবে, রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনীতির মুক্তি এবং আমাদের সংস্কৃতির মুক্তি কিংবা চেতনার শুদ্ধি মুক্তি। ভাষাকে বেয়ে আমরা জয় করতে চাই। আমাদের জয় হবে বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে। তবে সব জয়ের মূলমন্ত্র হবে ভাষার জয়। সে ভাষা আমার বাংলা ভাষার জয়, সে জয় আমাদের বাঙালির ভাষার জয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জয়।  

গৌতম কুমার রায় 
গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]