logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০
স্থলবন্দরে দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা চায় দুদক
১৪ উৎস চিহ্নিত করে ২৮ দফা সুপারিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক টিম বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের (স্থলবন্দরগুলো) ১৪টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৮ দফা সুপারিশও করেছে সংস্থাটি। বুধবার সচিবালয়ে এসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর হাতে তুলে দেন দুদকের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান। দুদক কমিশনার বলেন, দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধিবিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব এবং জনবল সংকটের কারণে যেসব দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়, এর উৎস চিহ্নিতকরণসহ সেগুলো বন্ধে বা প্রতিরোধে বাস্তবতার নিরিখে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সুপারিশ দিতে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। স্থলবন্দরগুলোর আইন, বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এ প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশ দিতে কমিশনের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে একজন উপপরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ১৬টি রিপোর্ট আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেছি।
দুদক কমিশনার জানান, এ প্রাতিষ্ঠানিক টিম অনুসন্ধানকালে স্থলবন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা এবং এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করেন। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক টিম স্থলবন্দরগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসহ ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিবৃতি, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করে। মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আমি অকপটে স্বীকার করছি, এটি বিশাল কোনো গবেষণা কাজ নয়। কোন জায়গায় দুর্নীতি হয়Ñ এমন ১৪ জায়গার কথা আমরা মোটামুটি বলার চেষ্টা করেছি। এ উৎসগুলো যদি আমরা বুঝতে পারি আমাদের বিশ্বাস সেসব জায়গায় যদি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অধিকতর নজরদারি করেন, দায়িত্ব যদি আরেকটু সুচারুভাবে পালনের চেষ্টা করেন, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য এটি ব্যাপক কাজ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে। এ কাজটি করার জন্য আমরা ২৮টি সুপারিশ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি অকাট্য কোনো বিষয় নয়, আবার এটি সামান্য বলে ফেলে দেওয়ার বিষয়ও নয়। এটি একটি দলিল, আমরা বিশ্বাস করি মন্ত্রণালয় এটি বিবেচনায় নেবে। বিবেচনায় নিলে দেশের জন্য লাভজনক হবেÑ এ বিশ্বাস থেকে আমরা এটা দিচ্ছি।’
নৌপ্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়বÑ এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ। স্থলবন্দর নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, আমরা সেটাকে স্বাগত জানাই। এরই মধ্যে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। এগুলো সঙ্গে আমরা দ্বিমত করব না।’ স্থলবন্দরে বন্দর কর্তৃপক্ষ এককভাবে কাজ করে না জানিয়ে খালিদ মাহমুদ বলেন, এখানে অনেক সংস্থা জড়িত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বিজিবি আছেÑ এতগুলো সংস্থাকে নিয়েই কাজ করতে হয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটাকে আমরা দলিল হিসেবেই নিচ্ছি। এগুলোকে আমরা বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা করে, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে যতটুকু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেব। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সব সময় সজাগ আছে।’
দুর্নীতির উৎস : স্থলবন্দরে দুর্নীতির ১৪টি উৎস তুলে ধরে দুদক কমিশনার বলেন, অধিকাংশ স্থলবন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বন্দর ও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় প্রায় বিনা শুল্কে আমদানিকৃত মালামাল বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থলবন্দরগুলোর কেনাকাটায় সরকারি ক্রয় আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় স্থানীয় ব্যক্তিরা নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ ও বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি ও স্বচ্ছতা না থাকায় কাজে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সব শ্রমিকের নামে বিল উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে বলে জানান দুদক কমিশনার। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে একই স্টেশনে কর্মরত থাকায় বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বন্দরকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের এক ধরনের সখ্যতা গড়ে ওঠার অভিযোগ পাওয়া যায়। মালামাল হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় অযোগ্য ঠিকাদাররা কাজ পেয়ে থাকে।
দুদকের কমিশনার জানান, বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে দ্রুত পণ্য ছাড়করণের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাবেও কোনো কোনো সময় দুর্নীতির উদ্ভব ঘটে। আমদানিকারক ও কাস্টমস বিভাগ সূত্রে প্রায়ই বন্দরের শেড থেকে মালামাল চুরির অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন বড় কাজকে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত কোটেশনের মাধ্যমে কার্য সম্পাদনের অভিযোগ রয়েছে। এতে প্রতিযোগিতামূলক দরের পরিবর্তে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে কার্যাদেশ প্রদানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি ও পদায়ন এবং বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য কর্মকর্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায়ই আঞ্চলিকতা বা এলাকাপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে পছন্দসই ব্যক্তিদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বা সিবিএর পদাধিকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে কমিশন বাণিজ্য ও চোরাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করে অযোগ্য ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ঘুষ দাবি, হয়রানি, পেশাদারিত্বের অভাব এবং বন্দরের অভ্যন্তরে নানা অসামাজিক কর্মকা- পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন স্থলবন্দরের অফিস ভবন, শেড, ইয়ার্ড ও ওয়েব্রিজ স্কেলে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয়ভাবে টেন্ডুল নামের ভাড়া করা বহিরাগত লোকদের দিয়ে দাপ্তরিক কাজ করিয়ে থাকেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এসব টেন্ডুলদের মাধ্যমে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে থাকেন। একই ব্যক্তিকে বারবার বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালনা বোর্ডের খ-কালীন সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বলেও দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুপারিশ : মালামাল হ্যান্ডলিংয়ের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতা আনতে পর্যায়ক্রমে সব স্থলবন্দরে অটোমেশন সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের এক বা একাধিক যৌথ ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা যেতে পারে বলে দুদকের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, কাস্টমস গোয়েন্দাসহ অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রশাসনিক, আইনি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা যেতে পারে। সমন্বয়, মনিটরিং, সুপারভিশন ও নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে বন্দরের সব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। স্থলবন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কাজে বন্দরের নিজস্ব ইকুইপমেন্টের (ক্রেন, ফর্কলিফট) ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন্দর মাশুল ও শুল্ক ফাঁকি রোধে বন্দরের ওয়েব্রিজ স্কেলে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক ও খালি ট্রাকের ওজন নিশ্চিতকরণ করা যেতে পারে। সার্বিক নিরাপত্তাসহ অপারেশনাল কার্যক্রম (আন্তর্জাতিক প্যাসেনজার টার্মিনালসহ) মনিটরিং ও তদারকির জন্য পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। বহুল আলোচিত বন্দরের চোরাই চক্রকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেসঙ্গে বন্দরগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এ চক্রকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স সেলের মতো আলাদা একটি সার্ভিল্যান্স ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। ওপেন টেন্ডার প্রক্রিয়া ইজিপির মাধ্যমে সম্পাদন নিশ্চিত করা যেতে পারে। শুল্ক আদায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে। আমদানি করা পণ্যের পরীক্ষণের সময় কাস্টম কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে দুদকের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]