logo
প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শনিবার, ফেব্রুয়ারী ২৯, ২০২০
প্রেমিক হলে বিনিদ্র রাত কাটাও
মাওলানা রূমীর মসনবী শরীফ (কিস্তি-২১২)
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

 

মানুষ পৃথিবীতে যা কিছু দুর্ভোগ পোহায় তার জন্য সে নিজেই দায়ী। আল্লাহ পাক তো সবার প্রতি সদয়। বান্দার প্রতি তার রহমত, দয়া ও মহব্বতের অন্ত নেই। প্রতি রাতে আল্লাহ বান্দার জন্য অপেক্ষায় থাকেন আর ডাক দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অপেক্ষায় থাকেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ আসে তখন তিনি দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আসেন। আর বান্দাদের ডাক দিয়ে বলেন, কোনো তওবাকারী কী আছ, আমি তার তওবা কবুল করব। গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ কী আছ, আমি তার গোনাহখাতা মাফ করে দেব। কোনো কিছু চাওয়ার কী কেউ আছ আমি তার প্রার্থিত জিনিস দান করতাম। ফজর অবধি এ আহ্বান অব্যাহত থাকে।’ (বোখারি ও মুসলিম)

আগেকার দিনের এক প্রেমিকের কথা। অভিজাত ঘরের এক রূপসীর প্রেমে সে আত্মহারা মজনু। প্রেমের উন্মাদনায় তার জীবনের আরাম হারাম হয়ে যায়। পাগল বেশে ঘুরে আর বলে বেড়ায়, এক প্রেয়সীর মায়ায় আমার প্রাণ যায় যায়। আমার এই প্রাণ তার মুঠোয় তুলে দিতে আমি প্রস্তুত। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে একটিবারের জন্য হলেও তার সান্নিধ্যে প্রাণ জুড়াতে চাই। এক-দুই দিন নয়, মাস পেরিয়ে এভাবে বছর কেটে যায়। তবুও আশার আকাশে চাঁদ হাসে না। মনের বেদনা কোথাও রাখতে পারে না। তবে প্রকৃতির শাশ^ত বিধান হলো, ‘যে সন্ধান করে সে পেয়ে যায়।’ 
আ’কেবাত জুয়ান্দে পা’য়ান্দে বুয়াদ
কে ফারাজ আজ সবর যা’য়ান্দে বুয়াদ
যে সন্ধানী হয় সে অবশ্যই পেয়ে যায়
কেননা, সবর হতেই সাফল্যের বীজ জন্মায়।
যত বড় সমস্যা হোক ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা ও সাধনায় অবশ্যই সব জটিলতার তালা খুলে যায়। ধৈর্য মানে লক্ষ্য অর্জনের পথে যত বাধাবিপত্তি আসুক অস্থির ও হতাশ না হয়ে নীতির ওপর অবিচল থেকে চেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যাওয়া। এটিই জীবনে সাফল্যের মূলমন্ত্র। এ জন্যই বলা হয় ‘সবরে মেওয়া ফলে’। আসসাবরু মিফতাহুল ফারাজ (সবর মুক্তি ও সাফল্যের চাবি)। কোরআন মজিদে তো অনেক বড় কথা বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা বাকারা : ১৫৩)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এই শাশ্বত নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি এই প্রেমিকের বেলায়ও। এক শুভ দিনে শুভ বার্তা আসে প্রেয়সীর কাছ থেকে। অনেক যাতনার পর প্রেয়সীর মনটা যেন তার প্রতি সদয় হলো। ছোট্ট চিরকুটে লিখে পাঠিয়েছেÑ ‘তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। অমুক স্থানে অমুক কামরায় তোমার সঙ্গে কথা হবে। তোমার পছন্দের স্যুপ নিয়ে হাজির হব নিশিরাতে। কথা দিলাম আসব তোমার সাক্ষাতে।’ 
দর ফোলান হুজরে নশীন তা নীমে শব
তা বিয়ায়াম নীমে শব মান বী তলব
অমুক কামরায় বস অপেক্ষায় মধ্যরাতে
ডাকতে হবে না নিজেই আসব নিশির শেষে।
মমতায় ভরা এমন বার্তা পেয়ে প্রেমিকের আনন্দ তর সয় না। এমন শুভ সংবাদের শুকরিয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। দান-সদকায় শুভক্ষণের অপেক্ষায় চলে যায় প্রাণের নজরানা নিয়ে প্রেয়সীর কাছে।
শব দর আন হুজরা নেশাস্ত অন গর্ম দার
বার উমীদে ওয়াদায়ে আ’ন য়া’রে গা’র
রাতে গিয়ে বসে সেই কামরায় অপেক্ষায় আকুল প্রাণ
নিশিরাতে পরম প্রিয়তম আসবে আশায় অপেক্ষমাণ।
প্রেয়সীর আশ্বাসে বিশ্বাস নিয়ে প্রেমিক হাজির হয় নির্দিষ্ট স্থান ও কামরায়। রাত যত ঘনায় অপেক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ হয় অধীর প্রতীক্ষায়। 
বা’দে নিসফুল লাইল আমদ য়ারে উ
সাদেকুল ওয়াদানে আন দিলদারে উ
নিশিরাত শেষে এলো প্রিয়তম শিয়রে তার
যেভাবে কথা ছিল সঙ্গে মিলনের উপহার।
কিন্তু প্রেমিকের অবস্থা দেখে প্রেমাস্পদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগল। মনটা খারাপ হলো প্রেমের দাবিদারের প্রতি।
আশেকে খোদ রা ফতাদা খোফতা দিদ
আন্দাকী আয আস্তীনে উ দরীদ
দেখে তার প্রেমিক পড়ে আছে ঘুমে অচেতন
জামার আস্তিন ছিঁড়ে চিহ্ন এঁকে দিল তখন।
গভীর রাতে প্রিয়তম এসে দেখে তার প্রেমিক পড়ে আছে বিছানায়। নিদ্রায় অচেতন। প্রেমের গালভরা বুলি আওড়ায়। অথচ মিলনের কথা দিলাম, সজাগ থাকল না আমার অপেক্ষায়, নির্দিষ্ট ঠিকানায়। এমন প্রেমিকের আমার প্রয়োজন নেই। এই বলে ঘুমন্ত লোকটির জামার আস্তিন ছিঁড়ে দিয়ে বলল, প্রেম কোনো ছেলেখেলা নয়। তুমি প্রেমিক হওয়ার যোগ্য নও। যাও শিশু-কিশোরদের দলে গিয়ে খেলা কর। এই বলে ঘুমন্ত প্রেমিকের পকেটে কতক আখরোট ভরে দিয়ে প্রেয়সী চলে গেল নিঃশব্দ পায়ের ছন্দ তুলে। 
চোন সাহার আয খাব আশেক বর জহীদ
আস্তীন ও গেরদুগান হা রা বেদীদ
ভোর হলে প্রেমিক লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে
দেখে আস্তিন ছিঁড়া কতক আখরোট তার পকেটে।
ঘুম ভাঙতেই চমকে লাফিয়ে উঠল প্রেমিক কিছু হারানোর আতঙ্কে। প্রেমাস্পদের অপেক্ষায় থাকতে কখন চোখে ঘুম নেমেছিল জানা নেই। ঘুম ভাঙতেই আতঙ্কে ভাবে, প্রেমাস্পদ আসেনি তো। দেখে তার জামার আস্তিনটা ছেঁড়া, পকেটে কতক আখরোট। মাথায় হাত দিয়ে বলে, হায় প্রেমাস্পদ তো এসেছিল ঠিকই। কিন্তু আমিই বড় বেওয়াফা; প্রিয়তমের কথার মূল্য রাখিনি, আমার পোড়া কপাল। অথচ আমার প্রেমাস্পদ মহান উদার।
গোফত শাহে মা হামা সিদকো ওয়াফাস্ত
অনচে বর মা মী রসদ আন হাম যে মাস্ত
বলল, সততা বিশ্বস্ততায় জুড়ি নেই আমাদের বাদশার
আমাদের ওপর যা আপতিত আমাদেরই অর্জিত দায়ভার।
প্রেমিক গভীর উপলব্ধি থেকে স্বগতোক্তি করে, আমার প্রেমাস্পদ, আমার হৃদয়রাজ, আমার বাদশাহ সততা বিশ্বস্ততায় তার জুড়ি নেই। যেই কথা দেন হুবহু পালন করেন। যত দোষ অবহেলা বিশ্বাসভঙ্গ তার জন্য দায়ী আমরা। ‘অনচে বর মাস্ত আয মাস্ত’ ‘আমাদের ওপর যা আপতিত আমাদেরই অর্জিত’ এই প্রবাদ নিরেট সত্য। এই প্রবাদের উৎস ফারসি সাহিত্যের আরেক দিকপাল নাসির খসরু। নাসির খসরু মানব জীবনের একটি অমোঘ সত্য তুলে ধরতে গিয়ে যে মন্তব্যটি করেন তাই রূপ নিয়েছে প্রবাদে। নাসির খসরুর কবিতাটি এখানে সামনে আনতে চাই।
একদা এক ঈগল পাথরের ওপর থেকে উড়াল দেয় আকাশে
খাবারের খোঁজে ডানায় ছন্দ তুলে দূর পবনে ভাসে।
ডানার শক্তি মেপে বলে আনন্দে এমন কে আছে
আজ পৃথিবীর সব কিছু আমার এই ডানার নিচে।
আরো ঊর্ধ্বে যখন উড়াল দেব ক্ষীপ্র গতিতে আবার
সাগর তলের ক্ষুদ্র প্রাণীও থাকবে না দৃষ্টির আড়াল।
মাটির ওপর একটি মশাও যদি ওড়াওড়ি করে
তুচ্ছ মশার পাখনার স্পন্দন থাকবে আমার নজরে।
আমিত্বের বড়াইয়ে বেসামাল ঈগল তকদিরের ভয় নেই
দেখ কিসে কি হলো দিক চক্রবালের আচরণ কত অন্যায়।
গোপন এক স্থান হতে নিক্ষিপ্ত একটি তীর ছুটে এসে
আঘাত করল বিঁধল সোজা ঈগলের পার্শ্বদেশে।
ঈগলের ডানা বিঁধল তীরে কপালের লিখন এমন
ঊর্ধ্ব আকাশে তড়পায় তারপর নিচে করুণ পতন।
মাটিতে পড়ে ধড়ফড় করে যেন ডাঙায় নদীর মাছ
ডানবামে তাকায় ধরাশায়ী আকাশের দুরন্ত বাজ।
অবাক হলো যখন দেখল একটি কাঠিতে লোহার শলা
ধুলায় নামিয়ে এনেছে আমায় কেমন তীক্ষè ফলা।
নিজেকে তিরস্কার করে বলে ঈগল, দোষ দেব কার
আমাদের ওপর যা আপতিত আমাদেরই অর্জিত, দায়ভার।
হ্যাঁ, মানুষ পৃথিবীতে যা কিছু দুর্ভোগ পোহায় তার জন্য সে নিজেই দায়ী। আল্লাহ পাক তো সবার প্রতি সদয়। বান্দার প্রতি তার রহমত, দয়া ও মহব্বতের অন্ত নেই। প্রতি রাতে আল্লাহ বান্দার জন্য অপেক্ষায় থাকেন আর ডাক দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অপেক্ষায় থাকেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ আসে তখন তিনি দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আসেন। আর বান্দাদের ডাক দিয়ে বলেন, কোনো তওবাকারী কী আছ, আমি তার তওবা কবুল করব। গোনাহ মাফ চাওয়ার কেউ কী আছ, আমি তার গোনাহখাতা মাফ করে দেব। কোনো কিছু চাওয়ার কী কেউ আছ আমি তার প্রার্থিত জিনিস দান করতাম। ফজর অবধি এ আহ্বান অব্যাহত থাকে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
এ সময় যারা ঘুমিয়ে কাটায়, মুখে হাজার দাবি করলেও আল্লাহর সত্যিকার প্রেমিক তারা নয়। যারা আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক তাদের অবস্থা হয়Ñ তাদের দেহপাশ শয্যা থেকে আলগা হয়ে যায় অর্থাৎ ইবাদতের জন্য তারা গভীর রাতে শয্যা ত্যাগ করতে অভ্যস্ত তখন তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায় এবং আমি তাদের যা রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। (সূরা সজিদা : ১৯)।
অতএব তুমি
খা’ব রা বুগযার এমশব আই পেদার
য়্যক শবী বর কূয়ে বী খাবান গুযার
আজ একটি রাত ঘুম ছেড়ে দেখ কেমন লাগে
যারা বিনিদ্র রজনী কাটায় ঘুরো তাদের গালিতে।
অলসতার ঘুমঘোর থেকে জাগ্রত হও। যারা আল্লাহর পথে জাগ্রত, দ্বীনের কাজে সদা ব্যস্ত, যাদের ধ্যানে জ্ঞানে আল্লাহ, রাসুল, আখেরাত, দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ, যারা মনের কানে বন্ধুর আহ্বান শুনে রাত জেগে ইবাদতে নিমগ্ন থাকে তাদের সঙ্গে একটিবার মিশে দেখ। তাদের অবস্থা পতঙ্গের মতো। পতঙ্গ যেমন জ্বলন্ত প্রদীপে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয় এরাও আল্লাহর পথে সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এরা প্রেমের দরিয়ায় নিমজ্জমান। তুমিও তাদের সাথী হও, ঘুমের ঘোর থেকে জেগে ওঠো। কোরআন মজিদের ভাষায়, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গী হয়ে থাক।’ (সূরা তওবা : ১১৯)।

মাওলানা রূমীর  মসনবী  শরীফ 
(৬খ. বয়েত-৫৯৩-৬৪০)
ফোন : ০১৭১১-১১৫৮২৯, [email protected] 

সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected]