প্রকাশ: ১২:০০:০০ AM, শনিবার, ফেব্রুয়ারী ২৯, ২০২০ | |
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা আলাদা র্যাংকিংয়েই টানা কয়েক বছর ধরে দেশসেরার খেতাব ধরে রেখেছে রাজশাহী কলেজ। তবে এ কলেজে বেপরোয়া ছাত্রলীগের নেতারা। কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইমুল হাসান নাঈম ও তার অনুসারীদের কাছে জিম্মি রয়েছে কলেজটি। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, বেপরোয়া চাঁদাবাজি, হোস্টেলে সিট বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে ক্যাম্পাসে মূর্তিমান আতঙ্ক নাঈম গ্রুপের আতঙ্কে কেউ এতদিন মুখ খোলেননি। চাঁদাবাজির মামলায় গেল বুধবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন নাঈম ও তার এক অনুসারী। এরপরই সবাই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
নাঈমের বাড়ি নগরীর সিটি কলেজ সংলগ্ন রাজারহাতা এলাকায়। রাজশাহী কলেজ ছাড়াও সিটি কলেজকেন্দ্রীক অপরাধ রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন তিনি। আশপাশের একাধিক কোচিং সেন্টার থেকে নিয়মিত চাঁদাও তোলেন নাঈম ও তার অনুসারীরা। সেখানকার একটি কোচিং সেন্টারে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন নাঈম। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন ভুক্তভোগীরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী কলেজের পাশেই বাড়ি হওয়ায় বরাবরই বেপরোয়া নাঈম। তার নির্দেশে সব অপকর্ম সম্পাদন করে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাসিক দত্ত। তার সব অপকর্মের সহযোগী প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রোজেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক মাহাবুব রতনও। রয়েছে রাজশাহী কলেজে বেপরোয়া
ষ শেষ পৃষ্ঠার পর
নাঈমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি ক্যাডার বাহিনী। এরা ছাত্র হলেও বই-কলমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অভিযোগ রয়েছেÑ নাঈম, রাসিক, রতন, রোজেলসহ এ বাহিনীর অনেকেই আছেন যারা কেউই নিজেরা পরীক্ষায় বসেন না। কখনও জোরপূর্বক, কখনও বা ব্লাকমেইল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাদের হয়ে পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করেন। সম্প্রতি রাজশাহী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈমের ক্যাডার রতন মাহাবুব মানিককে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সাবরীনা শাহনাজ চৌধুরী।
রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিবের চাচাতো ভাই এই নাঈম। এ কারণে নাঈম এবং তার বাহিনী লাগামহীন অপকর্মের পরও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয় না নগর ছাত্রলীগ। এছাড়া রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক তরুণ নেতার আশীর্বাদও রয়েছে নাঈমের প্রতি। ফলে নাঈম এবং তার বাহিনীর নির্যাতন এবং চাঁদাবাজিতে সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠলেও দেখার কেউ নেই।
এদিকে, সিটি কলেজের ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে নাঈমের টর্চার সেল। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন নামে এক যুবককে এ টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যায় নাঈমের অনুসারীরা। এরপর তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। বাড়িতে ফোন দিয়ে দাবি করা হয় চাঁদা। আমজাদ জেলার মোহনপুর উপজেলার গোছাবাজার গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে। রাজশাহী মহানগরীতে তিনি নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের ব্যবসা করেন। আমজাদ গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ওই সময় নাঈমের টর্চার সেলে আমাকে লাঠি ও লোহার পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে আমার পরিবারের সদস্যদের ফোন দিয়ে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নাঈম। প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার এবং পরে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় বাকি টাকা দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর আমজাদের স্ত্রী জেসমিন খাতুন পুলিশে অভিযোগ করেন। এরপর আমজাদের মোবাইল ফোন নম্বর ট্রেস করে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নাঈম আমজাদকে মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় সোহাগ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তবে ঘটনার মূল নায়ক নাঈম হলেও থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, নাঈমের টর্চার সেলে এখনও নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজে মোট তিনটি হোস্টেলের সাতটি ব্লকে প্রতিবছর আসন ফাঁকা হয়। এ ফাঁকা আসনগুলোয় শিক্ষার্থী উঠানোর জন্য কলেজ ছাত্রলীগের সুপারিশ নিতে হয়। সেই সুযোগে ছাত্রলীগ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে, ক্ষেত্র বিশেষে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে। এ চাঁদা আদায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন নাঈম। চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, নাঈমকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে হোস্টেলে উঠেছি। আবার মাঝে মধ্যেই নাঈমের নাম করে দুই-একজন এসে চাঁদা নিয়ে যায়। রাজশাহী কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের কথামতো কাজ না করলেই ধরে ধরে পেটানো হয়। চাঁদা না দিলে বা মিটিং-মিছিলে অংশ না নিলে শিবির আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করা হয়।
২০১৬ সালের ১৭ মার্চ রাতে কলেজের মুসলিম হোস্টেলের নিউ ব্লকে ঢুকে নাঈমের সঙ্গে করমর্দন না করার কারণে তিন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন নাঈম ও তার বাহিনী। এর মধ্যে মামুন নামের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী পঙ্গু হয়ে যায়। এছাড়া ছাত্রলীগের মিছিলে সেøাগান দিতে দেরি হওয়ায় ফিরোজ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে ধরে পেটান নাঈম। রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছেন ছাত্রলীগের নাঈম। তার দাপটে যেন সবাই অস্থির। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সে যা ইচ্ছা তাই করছে। অথচ দেখার কেউ নেই।
অপরদিকে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করে নাঈম বাহিনীর সদস্য রাসিক দত্ত ও রতনসহ অন্তত ১০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ হামলায় আহত হন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল্লাহ মিম, পদ্মা নিউজের সাব এডিটর বাবর মাহমুদ এবং বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ডট কমের প্রতিবেদক মোফাজ্জ্বল বিদ্যুৎ। ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে নাঈম নানা অপকর্ম করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পান না। রাজিবের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে নাঈমকে বহিষ্কার করা হয়। এর কিছুদিন পরই তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। কিন্তু এরপরও থামেনি দলের নামে নাঈমের অপকর্ম। নাঈম এবং তার বাহিনীর সদস্যদের অপকর্মের ব্যাপারে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাজশাহী কলেজ মহানগর ছাত্রলীগের আওতাভুক্ত ইউনিট। নাঈমসহ ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে মহানগর ছাত্রলীগ নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
নাঈমকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিব বলেন, নাঈম আমার আপন চাচাতো ভাই হলেও তাকে সব সময় শাসন করার চেষ্টা করেছি। নাঈম হয়তো দুই-একটা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। নিজের যোগ্যতাতেই নাঈম রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন, আমি সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। নাঈমকে গ্রেপ্তারের কথা শুনেছি। চাঁদাবাজি ও ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ফের তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |