আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১২-০৩-২০১৬ তারিখে পত্রিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্তে ফায়ারআই

৫৬ শতাংশ জুয়ার বোর্ডে ৪৪ শতাংশের হদিস নেই

জিয়াদুল ইসলাম
| প্রথম পাতা

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনার তদন্ত সন্দেহের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশনা গেছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আর অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততার বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট কোড (এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের সঙ্কেতলিপি) ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোয় সন্দেহ আরও জোরালো হচ্ছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানা মনে করছেন, ম্যালওয়্যার বা ভাইরাসজনিত কিছু বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে প্রবেশ করিয়ে এ হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটানো হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার কীভাবে হ্যাক হলো, হ্যাকারদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও যোগসাজশ আছে কিনা তার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে পৃথকভাবে তদন্ত করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তদন্তে সহায়তা করছে সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরম্যাটিক্স ও ফায়ারআই। সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে এফবিআই ও মার্কিন বিচার বিভাগও। বৃহস্পতিবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে ফায়ারআই, এফবিআই ও মার্কিন বিচার বিভাগ কর্তৃক তদন্তে সহায়তার কথা জানানো হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অবস্থিত তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়। পরে জানা যায়, এর মধ্যে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের আরবিসি ব্যাংকের একটি শাখার পাঁচটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ অর্থ পরে ফিলিপাইনের তিনটি ক্যাসিনো হয়ে হংকংয়ে চলে গেছে। শুক্রবার ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক ইনকোয়ারা তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে চুরি যাওয়া যে অর্থ ফিলিপিন্স ব্যাংকে গেছে, তার বড় একটি অংশ দেশটির ক্যাসিনো শিল্পে ঢুকেছে। ক্যাসিনোতে খরচ হওয়া টাকা ফিলিপিন্স ব্যাংকে পাঠানো অর্থের ৫৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে তদারকিতে নিয়োজিত সংস্থা ফিলিপিন্স অ্যামিউজমেন্ট গেমলিং করপোরেশন (পেগকর)। বাকি ৪৪ শতাংশ অর্থের গতিপথ সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের জানা নেই বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির এক কর্মকর্তা। এ প্রেক্ষাপটে ফিলিপিন্সে বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকড হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কম বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এক ফিলিপিন্স ব্যবসায়ী। 
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত কমিটির সদস্য তানভির হাসান জোহা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী ব্যবস্থা-সুইফটের সঙ্কেতলিপি ব্যবহার করেই যে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছিল এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমেই হ্যাকার ঢুকেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নয়। তবে যেখান থেকেই হ্যাকড হোক না কেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা গেছে, ভাইরাস ইনফেকশন অথবা অভ্যন্তরীণভাবে পিন কোড না দিলে এ অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার থেকে ব্যাপক ডাটা চুরি হয়েছে। এটা ভবিষ্যতে মিস ইউজের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কে ঘটাল সেটা বের করা না গেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার আরও বড় আক্রমণের শিকার হতে পারে। তখন সাইবার আফডেটও কোনো কাজে আসবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা ছাড়া এটা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা যাচ্ছে না। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও না কারোর সম্পৃক্ততা থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ফিলিপাইনের জুয়ার বাজারের টাকা উদ্ধার হওয়া সম্ভব কিনা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা ফেরত আনার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করেই অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে হ্যাকাররা কীভাবে, কোথা থেকে ঢুকলো সেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু এটা অত্যন্ত টেকনিক্যালি করা হয়েছে, তাই এটার প্রকৃত রহস্য বের করতে সময় লাগবে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া কি করে সম্ভব, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কে বা কারা জড়িত সেটা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। তবে হ্যাকাররা কম্পিউটার সার্ভারে ম্যালওয়্যার বা ভাইরাসজনিত কিছু পাঠিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাদের কাজই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সার্ভার ব্যবস্থায় এ ধরনের ভাইরাস পাঠানো। এটা ঢুকে গেলে তখন আর কারও সহযোগিতার দরকার হয় না। এদের কাজ আজ পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। তবে যেহেতু এ ঘটনায় যারা টাকা বের করে নিয়েছে, তাদের ধরা গেলে নেপথ্যে অন্য কেউ ছিল কিনা সেটিও বের করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কাজে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার লোকও ছিল। এ ঘটনায় তারা জড়িত থাকতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। সবই দেখা হচ্ছে।    
অর্থ চুরির তদন্তে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফায়ারআই : ফেডারেল রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরির ঘটনা তদন্ত করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ফায়ারআই। বৃহস্পতিবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনাও করেছে এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট। তবে ওয়ার্ল্ড ইনফরম্যাটিক্সের পরামর্শে অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে ফায়ারআইয়ের ম্যানডিয়েন্ট ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনাগুলোর বেশ কয়েকটির তদন্ত করেছে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানি ফায়ারআই। ওয়ার্ল্ড ইনফরম্যাটিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানাই ফায়ারআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিভাগে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ হ্যাকাররা কীভাবে চুরি করল তা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এবং জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনাও করেছে এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট। তবে ওয়ার্ল্ড ইনফরম্যাটিক্সের পরামর্শে অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে ফায়ারআইয়ের ম্যানডিয়েন্ট ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে তারা জানিয়েছে, অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে ফেডারেল রিজার্ভ। সাইবার অপরাধীরা কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেছে, লুট হওয়া অর্থ কোথায় গেছে এবং ওই অর্থ উদ্ধার করা যাবে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত শেষে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। তবে এফবিআই, ইউএস সিক্রেট সার্ভিস, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ও ইউএস ট্রেজারির ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত অর্থ চুরির যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ঘটনাকে ‘অন্যতম বড়’ বলে দাবি করেছে রয়টার্স।