আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে একের পর এক অভিযোগ এলেও তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রভাবশালী প্রার্থীরা নানা ধরনের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক প্রার্থীকে বাড়িছাড়া করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরা। তবে এসব অভিযোগের কোনোটাই আমলে নিচ্ছে না বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদের ভোট যতই ঘনিয়ে আসছে; বিভিন্ন স্থানে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও গোলযোগের শঙ্কাও বাড়ছে। তবে প্রথম ধাপে ৭৩৩ ইউপির তফসিল ঘোষণার প্রায় মাস পার হতে চললেও অভিযোগ তদারকিতে নির্বাচন কমিশনের ‘গাছাড়া’ ভাব দেখা যাচ্ছে। কাজের মধ্যে লোকদেখানো একটি কমিটি গঠন করেই দায় সেরেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। জানা যায়, প্রচারণা শুরুর পর থেকে প্রতিদিন দুই ডজনেরও বেশি অভিযোগ আসতে শুরু করেছে ইসি সচিবালয়ে। তবে এসব অভিযোগ খুলে দেখারও কেউ নেই ইসিতে। নির্বাচনের সবকিছুতেই গাছাড়া ভাব ইসির।
ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার উপসচিব সামসুল আলম জানান, প্রথম ধাপে এরই মধ্যে ৬২ চেয়ারম্যান, ১৭৯ সাধারণ সদস্য ও ৫৪ সংরক্ষিত সদস্যপদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী ২২ মার্চ ৭৩৩ ইউপিতে প্রথম ধাপে ভোট হবে। এতে ৩ হাজার ৩৬ চেয়ারম্যান প্রার্থী, সাধারণ সদস্যপদে ২৫ হাজার ৮৪৭ ও সংরক্ষিত পদে ৭ হাজার ৫৭৫ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন। তৃণমূলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ইউপিতে প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে ভোট হচ্ছে। দলীয় একক প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় ইসির সমন্বয় সভায় হট্টগোলের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
সম্প্রতি ইসিতে অভিযোগ জমা দিয়েছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ২নং বাকাল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মহিলা চেয়ারম্যানপ্রার্থী লাবণ্য আক্তার তালুকদার। অভিযোগপত্রে তিনি লিখেন, রাতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। ভোটারদের বলা হচ্ছে, ভোট কেন্দ্র থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নেয়া হবে, একজন প্রার্থীকে প্রকাশ্যে ভোট দিতে হবে। তা না হলে কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলেও অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন। এর আগে এই এলাকার নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও এজেন্ট বের করে দেয়ার নজির রয়েছে উল্লেখ করে এই প্রার্থী লিখেছেন, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ইউপি নির্বাচনে হতে পারে। একই উপজেলার ৫নং রত্নপুর ইউপির চেয়ারম্যানপ্রার্থী মোঃ শাহীন আলম সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ইসিতে অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ৪নং নাংলা ইউপির চেয়ারম্যানপ্রার্থী শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন কমিশনে স্থানীয় এক নেতার মোবাইল কথোপকথনের সিডি জমা দিয়ে অভিযোগ করেছেন, তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন ওই নেতা। ভোট কেন্দ্র দখল করে সব ইউপিতে পছন্দের প্রার্থীদের জয়ী করা হবে বলে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার ৫নং বড়ইয়া ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান জাহিদুল আবেদীন (জাহিদ) অভিযোগ করেছেন একজন জনপ্রতিনিধির নাম উল্লেখ করে। তিনি বলেছেন, ওই জনপ্রতিনিধি প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে তার কর্মীদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দিচ্ছেন। ওই জনপ্রতিনিধির বাড়ির কাছে থাকা তিনটি ভোট কেন্দ্রে ভোট কারচুপির আশঙ্কা করে বাড়তি নিরাপত্তা চেয়েছেন তিনি।
সাতক্ষীরার কলোরোয়া উপজেলার ৫নং কেঁড়াগাছি ইউপির চেয়ারম্যানপ্রার্থী কমিশনে অভিযোগ করে বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিপক্ষের লোকজন বাধা দিচ্ছে, তার এক কর্মীর বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। এরকম শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে কমিশনে। এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব সামসুল আলম বলেন, প্রার্থী, প্রতিপক্ষ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসছে তা কমিশন দেখে ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় নির্বাহী হাকিম নিয়োজিত থাকায় আচরণবিধি তদারকিতেও কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস ফ্যাক্সযোগে পাঠানো বার্তায় বলেন, এই জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। দ্রুত কোস্টগার্ড সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব দেন তিনি। নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছেও এর অনুলিপি এসেছে।
তদারকিতে থাকলেও সাড়া নেই : মনোনয়নপত্র জমা, নির্বাচনী ব্যয় থেকে আচরণবিধি তদারকি করতে উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে আটটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোথাও অভিযোগ আসেনি বলে জানান ইসির আইন শাখার উপসচিব মহসিনুল হক। নামেমাত্র এসব তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। আচরণবিধি সংক্রান্ত প্রতিবেদন যাচাই কমিটির প্রধান জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব শাহেদুন্নবী চৌধুরী জানান, এখনও তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন নিয়ে অনেক এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। লিখিতভাবে ইসিতে কী অভিযোগ এলো, গোলযোগ-সংঘর্ষ কোথায় কোথায় হয়েছে তার কোনো তথ্য ইসি সংরক্ষণ করছে না। সঠিকভাবে মনিটরিং না করায় প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবে নেই কোনো অভিযোগ সেল। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ২ মার্চ থেকে নির্বাচনী এলাকায় উপজেলাভিত্তিক একজন করে নির্বাহী হাকিম মাঠে থাকার কথা থাকলেও তারা কাজে যোগ দিয়েছেন অনেক পরে। সবকিছুতেই গাছাড়া ভাব ইসির। এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে দফায় দফায় অভিযোগ এলেও তা আমলে না নিয়ে শুধু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলও পাল্টা অভিযোগ নিয়ে ইসিতে আসছে।
এসব বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব সামসুল আলম বলেন, আমাদের কাজ ভাগ করা রয়েছে। সবাই নিজ নিজ কাজের বিষয়ে সচেতন। এ নিয়ে সমন্বয়হীনতা নেই। মাঠ পর্যায়ে আচরণবিধি তদারকিতে নির্বাহী হাকিমের পাশাপাশি ভিজিলেন্স টিম ও কয়েকটি সমন্বয় কমিটি কাজ করছে।
অন্যদিকে নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্প উদ্বোধন ও প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা নিয়ে বরগুনা-২ আসনের হাচানুর রহমান রিমন ও পাবনা-২ আসনের খন্দকার আজিজুল হকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে দ্বিতীয় ধাপে মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার সব ইউপির ভোট বন্ধ করেছে ইসি। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে বেআইনি কার্যক্রম করা ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মার্চ-জুনের মধ্যে ছয় ধাপে ভোট হবে এবার ইউপি নির্বাচনে। ২২ মার্চ ও ৩১ মার্চ ভোটের জন্য প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। বাকি চার ধাপের বিস্তারিত তফসিল শিগগিরই দেয়া হবে। ভোটের আগে-পরে চার দিন বিজিবি-র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন। সেই সঙ্গে স্ট্রাইকিং ও মোবাইল ফোর্সের বাইরে কেন্দ্রে থাকবেন ২০ জন করে নিরাপত্তা সদস্য।