ইউপি নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২২ মার্চ ৭৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হবে। বিএনপির অভিযোগ, ৮৫টি ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও মনোনয়নপত্র ছিনতাই করা হয়েছে এমনভাবেই কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে বেশ কিছু স্থানে প্রার্থীদের আটক রাখা হয়েছে। প্রতিপক্ষের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ১৪ দল, ২০ দলীয় জোটসহ অনেক দলের পক্ষ থেকেই এমন অভিযোগ করতে শোনা গেছে। অশুভ লক্ষণ এগুলো।
প্রথমবারের মতো দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এরই মধ্যে এ নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, বিভিন্ন স্থানে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের হয়রানি শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে বিএনপি ও সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদকে স্থানীয় মানুষ নিজেদের ঘরের প্রতিষ্ঠান মনে করে থাকেন। সবচেয়ে কাছের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সব মিলিয়ে গ্রামের সাধারণ জনগণের কাছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকি এটিকে তারা উৎসবের উপলক্ষ মনে করেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে হলে গণতান্ত্রিক ভিত আরও শক্তিশালী হবে এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত কিনা ভেবে দেখা দরকার। কেননা এ নিয়ে বিভিন্ন মহল ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে। তবে আর যাই হোক নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে (প্রার্থী ও ভোটার) তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার পরিবেশ দিতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেই ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাই করার সুযোগ পান। এভাবে সৎ, যোগ্য, আদর্শ ও সক্ষম প্রার্থীর নেতৃত্ব লাভের পন্থা তৈরি হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, অথবা অসৎ উপায়ে বিজয়ী প্রার্থীর ভোটারদের কাছে জবাবদিহিতার কোনো চাপ থাকে না। তাই পরবর্তী সময়ে সেই জনপ্রতিনিধি বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।
নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির নির্দেশ মানতে বাধ্য। কিন্তু নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান প্রদত্ত প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো অদৃশ্য কারণে অনিচ্ছুক। মনোনয়নপত্র জমা দেয়া নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার আইনি প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন। প্রতিপক্ষের হামলার কারণে কোনো প্রার্থী যদি মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারেন, সেটি তার ব্যর্থতা নয়, এটা ইসির ব্যর্থতা, সরকারের ব্যর্থতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। পাড়ামহল্লা থেকে শুরু করে সবখানেই নির্বাচনী উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। চারদিকে নির্বাচনী ঢামাঢোল বাজলেও তৃণমূলে এ নির্বাচন পরিচালনা, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ সামগ্রিক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা এখনও মাঠ পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি। আর পৌঁছে থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিধিনিষেধ ভুলে নিজেদের ইচ্ছামাফিক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ থাকলেও ইসি কর্ণপাত করছে না।
এরই মধ্যে দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো পৌরসভা নির্বাচন সরকার করেছে। তা সুখকর হয়নি। ইউপি নির্বাচনও ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে সতর্ক সঙ্কেত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দেশে হতাশা সৃষ্টি হবে। অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। বাস্তবতা হলো, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে অবাধ ও সর্বজনগ্রাহ্য করার মতো কোনো কার্যক্রম লক্ষণীয় নয়।
আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত মানের অবনতিতে অনেকে হতাশ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর মানুষের আস্থার জায়গাটি দিন দিন শুধু দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। পেশিশক্তি বা জোরজবরদস্তির রাজনীতির যে দানবটি আমাদের প্রতিনিয়তই ধাওয়া করছে। সাধারণ মানুষ এ থেকে মুক্তি চায়। আর এর দায় ক্ষমতাসীন দলের ওপরই বেশি বর্তায়।
তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়া একান্তই জরুরি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার মূল দায়িত্ব বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনারের রয়েছে অগাধ ক্ষমতা। নিকটতম অতীতে উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকান্ড দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। আমরা প্রত্যাশা করি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। আর তা না করলে ইসি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রশাসনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। তার সঙ্গে নিজেদের ওপর রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের এটা বিবেচনা করা দরকার যে, ভোটারদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা সংস্থাটির জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়, এটি ভোটারবান্ধবও নয়। সবার মতো আমি আশা প্রকাশ করি, নির্বাচন কমিশন নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং ভোটারদের অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
অন্যান্য নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনে দৃশ্যমান তেমন কোনো তদারকির পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার সময় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক এ সংস্থাটির কার্যক্রম দেখে অনেকেই এমনটা মনে করছেন। সাধারণ জনগণের মনে শঙ্কা রয়েছে, নির্বাচন কি ফ্রি ফেয়ার হবে? অস্ত্র ও মাসলম্যানদের ব্যবহার হবে না তো? নির্বাচনে সবার জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড থাকবে তো? সাধারণ ভোটাররা কি নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন?
কোনো অভিযোগকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ঐতিহ্যগতভাবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন অপেক্ষাকৃত বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়। এতে স্থানীয় জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো কমতি থাকে না। কিন্তু প্রার্থীরা যদি নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্রই জমা দিতে না পারেন, তাহলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা এবং ভোটগ্রহণ কার্যক্রম যে সুষ্ঠু হবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত করতে নির্বাচন কমিশনকেই সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ