আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

শ্রবণযন্ত্রের সুরক্ষা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
| সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের বাইরে থেকে কেউ ঢাকা শহরে এসে পা রাখতে প্রথমেই শব্দসন্ত্রাসের তীব্র যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন। সত্যি বলতে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকার মতো এমন শব্দদূষণে আক্রান্ত রাজধানী শহর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। শব্দের সহনশীল মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ তীব্রতর শব্দ কখনও ঢাকাবাসীর কর্ণকুহরে এসে আঘাত হানছে। অজান্তেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে মানুষের শ্রবণশক্তিসহ শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে তা হয়তো অনেকেই তেমনটি টের পান না। জানেন না, এ শব্দ অগোচরে তার দেহের কতটা ক্ষতি করে চলেছে। এক গবেষণা মতে জানা যায়, ঢাকার অনেক জায়গায় শব্দ ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত উঠে যায়। অথচ ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দেই একজন মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারেন। উপযুক্তভাবে উদ্দীপিত হলে যে কোনো স্থিতিস্থাপক কম্পমান বস্তু শব্দের উৎস হিসেবে কম্পিত হয়। শব্দের উৎস বস্তুর শব্দানুভূতির সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ কম্পাঙ্কই শ্রুতিসীমা, যা ২০ সিপিএস থেকে ২০০০০ সিপিএস পর্যন্ত হতে পারে। ব্যক্তিভেদে কম্পাঙ্কসীমা পরিবর্তিত হতে পারে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কম্পাঙ্কের এ ঊর্ধ্বমাত্রা কমতে থাকে।
আইন অনুসারে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব জায়গায় গাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগে গাড়ির হর্নকেই প্রধান শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সুস্থ ও স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ার তীব্রতা পরিবর্তনের মান শ্রুতিসীমার মধ্যে থাকা জরুরি। শব্দের উচ্চ শ্রুতিসীমার বেশি তীব্রতা স্বাভাবিক শ্রবণক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেয়ে ধীরে ধীরে কানের শ্রুতি গ্রহণের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া শব্দের অতিরিক্ত তীব্রতা শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বজ্রপাতের শব্দের মতো দু-একটি ছাড়া শব্দদূষণের বেশিরভাগ কারণই মানুষসৃষ্ট। উচ্চ স্বরে কথা বলার সময়ও শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে কথোপকথনের সময় সৃষ্টি হওয়া ৬০ ডেসিবেল শব্দে কোনো দূষণ হয় না। তবে এক জায়গায় বেশি সংখ্যক মানুষ একত্রিত হলে সবার ধীরস্বরে কথা বলাও দূষণের সৃষ্টি করে। 
বাতাসের মাধ্যমে সহনক্ষমতার অধিক তীব্র বা তীক্ষè, বিশেষ করে সুরবর্জিত শব্দের উপস্থিতিতে মানুষ তথা জীব পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, তাকেই শব্দদূষণ বলা হয়। অপরিণামদর্শী মানুষ তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ ঘটিয়ে চলেছে। মানব সভ্যতার বিকাশমান ধারায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পের দ্রুত প্রভাব, পরিবহনের অবাধ প্রবাহ প্রতিনিয়ত সুরবর্জিত শব্দের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে শব্দদূষণও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পরিবহন। মাত্রাধিক ডিজেল ইঞ্জিনচালিত বাস, ট্রাক, কার, মোটরসাইকেল থেকে উত্থিত অনিয়ন্ত্রিত শব্দ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া এসব যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন হাইড্রলিক বা বৈদ্যুতিক হর্ন হচ্ছে শব্দদূষণের প্রধান উৎস। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থানেও এসব তীব্র শব্দের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। এছাড়া রেলস্টেশনের ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ৯০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে, যা মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সময় জেনারেটর ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। প্রচারের কাজে, সভায় বক্তৃতাকালে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারেও শব্দদূষণ হয়। আতশবাজির শব্দে তীব্র শব্দদূষণ ঘটে। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালানোর শব্দ এলাকায় দূষণের সৃষ্টি করে। এ ধরনের শব্দের মাত্রা সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ ডেসিরেল হয়ে থাকে। শিল্পকারখানার ব্যবহৃত সাইরেন থেকে ১৪০ ডেসিবল মাত্রার তীব্র শব্দ উত্থিত হয়। বিমানবন্দর এলাকায় বসবাসকারীদের কাছে বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় প্রায় ১১০ ডেসিবেলের শব্দদূষণ হয়ে থাকে। উচ্চগতির জেট বিমান ও কনকর্ড বিমানের শব্দদূষণ অসহনীয়।
শব্দের উৎসের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষই শব্দদূষণ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। সুরবর্জিত উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দ মানবদেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শব্দদূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষের শ্রবণশক্তির ওপর অস্থায়ী বা স্থায়ী যে কোনো ধরনের ক্ষতি হতে পারে, যা কালক্রমে শ্রবণশক্তিহীনতা থেকে বধিরত্বে রূপ নিতে পারে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগজনক বিষয়, সুরবর্জিত তীব্র শব্দ পরোক্ষভাবে মানুষের দেহে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এ ধরনের সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, রক্তচাপ, শ্বাসক্রিয়া, দৃষ্টিশক্তি, এমনকি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তা বেড়ে দেহের চলাচলে গতি-প্রকৃতির ক্রিয়া বিঘিœত হতে পারে। হৃৎপি-ের ও মস্তিষ্কের কোষের ওপর অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। একাগ্রতা হ্রাস পেয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া এবং মাথাধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কখনও উচ্চমাত্রার সুরবর্জিত শব্দের কারণে কানের পর্দা ছিঁড়ে গিয়ে আংশিক বা পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি বাতাসে ছড়িয়ে পড়া সুরবর্জিত শব্দদূষণের কারণে অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দ শুনতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। শব্দদূষণে মানবদেহের রক্তের শর্করার ওপর প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণে রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। এমনকি সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।
‘শ্রবণযন্ত্রের সুরক্ষা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা’ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে পালিত হলো এ বছর আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস। শব্দদূষণ রোধে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রযুক্তিগত এবং আইনগত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। বাড়িঘরে বিনোদনে ব্যবহৃত রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ যথাসম্ভব কমিয়ে শুনতে হবে। পেশাগত কাজে শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতিতে শব্দ প্রতিরোধক যন্ত্র লাগিয়ে নিতে হবে। আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকারের শব্দ সীমিত রাখতে হবে। এমনকি বাড়িঘরে এবং অফিস-আদালতে উচ্চ স্বরে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। মূলত যানবাহন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, কলকারখানা থেকে যে অনাকাক্সিক্ষত উচ্চশব্দ উত্থিত হয়, তা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব। শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উন্নত প্রযুক্তি মানসম্পন্ন হলে তা থেকে অপেক্ষাকৃত কম শব্দ রেরোবে, যা শব্দদূষণ রোধে সহায়তা করবে। উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রে শব্দ প্রতিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করলে তা থেকে শব্দদূষণ হবে না। শব্দদূষণ স্থানে শব্দ প্রতিরোধক ডিভাইস ব্যবহার শব্দদূষণ প্রতিরোধে ইতিবাচক ফল দেবে। স্থলপথের পরিবহন এবং বায়ুযানের চলাচলজনিত সামাজিক শব্দদূষণও প্রযুক্তিগত উপায়ে রোধ করা সম্ভব। সড়ক পরিবহনে ব্যবহৃত যানবাহনে কম শব্দ বেরোয়, এ ধরনের ইঞ্জিনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা জরুরি। 
১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন শহরকে নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকাÑ এ ৫ ভাগে ভাগ করে এলাকার দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে। ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করা হলে হাইকোর্ট রাজধানীতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এ আদেশে হাইড্রলিক হর্ন আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি।
আকাশপথে চলাচলকারী বাহনে কম শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ইঞ্জিন এরই মধ্যে বের হয়েছে। উৎসব-আয়োজনে মাইক বা লাউড স্পিকার বাজানোর জন্য শব্দসীমা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। আতশবাজির মতো উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সব ধরনের আয়োজন বন্ধ করা জরুরি। বাড়িঘরে, স্কুল-কলেজে, হাট-বাজারের মতো জায়গায় নিচু স্বরে কথা বলার অভ্যাস করা দরকার। শব্দদূষণ রোধে সমষ্টিগত উদ্যোগের বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত উদ্যাগ ও সচেতনতা বৃদ্ধিও এ ধরনের শব্দদূষণ বন্ধ করার সহায়ক হতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে নগরায়ণ, যানবাহন চলাচলে উচ্চমাত্রার শব্দ নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানার উৎপাদনের ক্ষেত্রে কম শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার ও সার্বিক পরিবেশসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সুরবর্জিত শব্দ-সঞ্চারণ নিয়ন্ত্রণ করে শব্দদূষণ অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। হ
 
ষ মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক