তৈরি পোশাক খাত অনেক শ্রমিক সম্পৃক্ত বড় ব্যবসা খাত। ব্যবসা খাতের বটবৃক্ষ। কথায় বলে যত বড় গাছ, তত বড় বাতাস। সেই বাতাসটা সুবাতাস হলেই ভালো হতো। সাধারণের প্রত্যাশা শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকের প্রাপ্তিটা যৌক্তিক হলেই এ খাতে সুবাতাস বইত
মে দিবসের একটা অন্তর্নিহিত বার্তা আছে, তা কি সবার ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পেরেছি? শতাধিক বছর আগে মে দিবসের উদ্ভব শ্রমের মর্যাদাকে ঘিরে, শ্রমের মূল্যায়নকে ঘিরে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে ঘিরে, যথাযথ কর্মপরিবেশকে ঘিরে, শ্রম ও সময়ের মূল্যকে ঘিরে। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের সংহতি ও ঐক্যের প্রতীক, শোষণমুক্তির অঙ্গীকার, অধিকার আদায়ের গভীর প্রেরণা। মে দিবস কর্মজগতে, শ্রমবাজারে আপসহীন সংগ্রামের কথা বলে। মে দিবস শ্রমিকের শ্রম বিনিয়োগের আস্থা, মনোবল ও অধিকারের কথাকে সামনে আনে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। মে দিবস শ্রমিক সমাজের আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন, মেহনতি মানুষের উৎসবের দিন। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্মরণীয় দিন, অধিকার আদায়ের এক বাঙময় অধ্যায়।
বিশ্বজুড়ে মে দিবসের মূলবার্তা একটাইÑ সেটা হলো শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ১ মে, মে দিবস গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হলেও শ্রমিক শ্রেণির দাবি-দাওয়া যথাযথভাবে আদায় হচ্ছেÑ এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ দেশীয় শ্রমবাজারের একটি বড় অংশজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির উপস্থিতি দেখা যায় তৈরি পোশাক শিল্প খাতে। আর সেই তৈরি পোশাক শিল্প খাতেই বছরের পর বছরজুড়ে শ্রম অসন্তোষ লেগেই আছে। যদি বছরের পর বছর শ্রম অসন্তোষকে লালন করতে হয়, তা হলে লোকদেখানো মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন বা মে দিবসের সরকারি ছুটি ভোগ করার বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে কি?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাজরীনের আগুন আর রানা প্লাজার ধসে হাজারেরও বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিলেও পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এ সময়ে আয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে (প্রথম আলো, ৬ নভেম্বর, ২০১৮)। যদিও সেই খাতের শ্রমিকের জীবন মান উন্নয়নের কোনো লক্ষণই দৃশ্যমান নয়।
শ্রমের বিনিময়ে যারা পারিশ্রমিক লাভ করে তারাই শ্রমিক। অর্থাৎ শ্রমের বিনিময় মূল্য বা পারিশ্রমিক অর্জনকারী ব্যক্তিই শ্রমিক। এ পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয় কীভাবে? শ্রমের ধরন বা পরিমাণ যাই হোক প্রত্যেক শ্রমিককে তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। আমাদের শ্রমবাজারে কলকারখানায় শ্রমিকের যে মূল্য নির্ধারণ করা আছে, সত্যিকার অর্থে কি একজন শ্রমিক তা দিয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে পারে?
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে ‘কী করে বাঁচে শ্রমিক’ নামক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৬১ শতাংশ শ্রমিক মনে করেন, তার আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা সামাল দেওয়ার জন্য শ্রমিকরা নিয়মিত ঋণ নেন এবং খাদ্য ও বাসাভাড়া বাবদ ব্যয় কমিয়ে দেন। গড়ে একজন পোশাক শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি মাসে গড়ে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেন। ফলে শ্রমিকরা প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হন... আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং দেশি মালিকের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা কমিয়ে আনতে পারলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করা সম্ভব।’
আমাদের প্রশ্ন, আসলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় কেউ মাসিক ১৬ হাজার টাকা মজুরি দিয়েও কি বাঁচার মতো বাঁচতে পারে? শ্রমিকরাও তো মানুষ, তাদেরও তো খেয়ে-পরে মানুষের মতো বাঁচতে হবে। সর্বনিম্ন মজুরিকাঠামোও একজন মানুষের খেয়েপরে বাঁচতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় সে বিবেচনায় হওয়া উচিত। মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্নে ৮ হাজার, ১০ হাজার বা ১৬ হাজার টাকা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। মজুরি বোর্ড গঠনের সময়ই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, যা হয়নি বলেই ৫ হাজার টাকায়, ৮ হাজার টাকায় সর্বনিম্ন মজুরি ঘুরপাক খাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও শ্রমিকরা সবচেয়ে কম মজুরি পান। শ্রমিকদের দাবি ছিল তাদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা করার। কিন্তু মজুরি বোর্ড ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে, যা আপত্তি সত্ত্বেও শ্রমিকরা মেনে নিয়েছিলেন ছোটখাটো অসংগতি আপসে সংশোধন করা যাবে, এই ভেবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের বিষয়টিও বিবেচনায় আসা উচিত। কারণ তারাও এ সমাজেই বসবাস করে, একই বাজারের চাল-ডাল খায়, একই রাস্তায় চলাফেরা করে।
এ পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, তা হলো শ্রমিক অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করলে সরকার একটা করে কমিটি গঠন করে, কয়েকটা মিটিং হয়, আন্দোলন থেমে যায়, মূল সমস্যা আর সমাধান হয় না।
তৈরি পোশাক খাত অনেক শ্রমিক সম্পৃক্ত বড় ব্যবসা খাত। ব্যবসা খাতের বটবৃক্ষ। কথায় বলে যত বড় গাছ, তত বড় বাতাস। সেই বাতাসটা সুবাতাস হলেই ভালো হতো। সাধারণের প্রত্যাশা শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকের প্রাপ্তিটা যৌক্তিক হলেই এ খাতে সুবাতাস বইত। প্রায় দেখা যায়, শ্রমিকের প্রাপ্তির যৌক্তিকতার ঊর্ধ্বে উঠেই মালিক শ্রেণি শ্রমিকের প্রাপ্যতাকে বিশ্লেষণ করে। এ ক্ষেত্রে মালিক শ্রেণি কমপক্ষে চারটি বড় যুক্তি খাড়া করে। যুক্তি চারটা হলোÑ প্রথমত, বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমে যাচ্ছে। বেশি বেশি প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। সেজন্য মজুরি বাড়ানো যাবে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম, সেজন্য মজুরিও কম। তৃতীয়ত, পোশাক শিল্পের সামর্থ্য নেই। মজুরি বাড়লে শিল্পে ধস নামবে। চতুর্থত, শ্রমিকরা তো দুই-তিনজন মিলে ভালোই আয় করছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে এসব যুক্তি খোঁড়া, অযৌক্তিক এবং একচোখা। তাদের একজন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ (বিশ্লেষণ দেখুন, নিম্ন মজুরি এবং মালিকপক্ষের চার যুক্তি, প্রথম আলো, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। এসব যুক্তির ফলে শ্রমিকদের বঞ্চনা বাড়ে, শ্রমের যৌক্তিক দাবির প্রাপ্যতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। শ্রমের দাবি সঠিকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। এটা আমাদের শ্রমবাজারে বিরাট একটা দুর্বলতা সৃষ্টি করে চলছে। পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকের যে শ্রম সম্পৃক্তি ঘটে, সেই শ্রমের যৌক্তিক মূল্য পাওয়া শ্রমিকের মৌলিক অধিকার। শ্রমিকের শ্রম সম্পৃক্তির মূল্য নির্ধারিত হবে শ্রমিকের প্রয়োজন অনুসারে, শ্রমিকের মৌলিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে। অন্যথায় টাকার অঙ্কে মজুরি কাঠামোতে সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ মজুরি নির্ধারণ কোনো সুফল বয়ে আনবে না। সেটাই শ্রমনীতির মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। শ্রমিকও রাষ্ট্রের নাগরিক, প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার পূরণে রাষ্ট্রের দায় আছে।
মে দিবসের আসল কথা হলো, সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের শ্রমের ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের স্বীকৃত দাবিকে স্মরণ করা, পালন করা, ন্যায্যতাকে অনুসরণ করা। যারা বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাদের সম্মান করা, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা। মে দিবস দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংকল্প গ্রহণের দিন। এ সংকল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপসাধন। শুধু তা-ই নয়, কর্মযোগের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে একটা দৃঢ় সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি। এমনটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে মে দিবস রাষ্ট্র এবং মালিক পক্ষকে সেই দায়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
শাওয়াল খান
লেখক ও শিক্ষাকর্মী