এ পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মাঝে তার বিবেক, মানুষত্ববোধ, মানবিকতাকে জাগ্রত করে তোলা। যখন
সে বুঝবে অন্যকে ঠকিয়ে কিংবা অবৈধভাবে উপার্জন করা সম্মানের নয় বরং অপমানের, তখন সে এগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারবে
প্রতি বছরের মতো এবারও ১ মে ‘মে দিবস’ বা ‘শ্রমিকদের অধিকার দিবস’ হিসেবে পালন করতে যাচ্ছে আজকের আধুনিক বিশ্ব। এখনও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আন্দোলনে যেতে হয়, রক্ত ঝরাতে হয়Ñ এমনকি দিতে হয় জীবন। এত দীর্ঘ সময় পরও তাদের সেই যৌক্তিক দাবির প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান করতে পারিনি। এটি সত্যিই লজ্জাকর। আমাদের দেশেও আমরা কিছু দিন পরপর লক্ষ্য করি শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। সেসব দাবি যে শুধু তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য করা তা নয়। বরং মাস শেষে বেতন বুঝে পেতে কিংবা ঈদের বোনাস পেতেও তাদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়, রক্ত ঝরাতে হয়। কিন্তু কেন? সভ্য সমাজের এবং উঁচুদরের মানুষগুলো কি কিছুই করতে পারে না? এই অভাবি শ্রমিকগুলো কি কোনোদিন তাদের যথাযথ অধিকার ফিরে পাবে না? আর কতদিন মালিক শ্রমিকের এ সম্পর্ক চোর-পুলিশের মতো থাকবে?
না, পুঁজিবাদী এই অর্থ ব্যবস্থায় এ পরিস্থিতি কখনও উত্তোরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে ক্ষমতা এবং সম্মান দুটোই নির্ভর করে অর্থ-সম্পত্তির ওপর। অর্থ-সম্পত্তি যার যত বেশি আছে তার ক্ষমতাও তত বেশি; সম্মানও (!) তত বেশি। এই বেশি বেশিতে যোগ হয় অন্যদের বেশি করে বঞ্চিত করার কিংবা ঠকানোর মানসিকতা। সুযোগও থাকে অন্যায়-অবিচার করে নির্বিচারে মাফ পেয়ে যাওয়ার। সেখানে অর্থহীন, গরিব কিংবা তার অধীন ছোট-বড় বেতনে চাকরি করা লোকগুলোকে সম্মান দেখানোটাকে তুচ্ছজ্ঞান করে, অসম্মানের মনে করে। ফলে, সত্যিকারের মানবিকতা উপেক্ষিত হয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রসার ঘটে স্বাভাবিক পন্থায়। অন্যকে ঠকিয়ে, দুর্নীতি করে, অন্যায় ও অবৈধ উপায়ে উপার্জন করা সম্পদ নিয়ে তাই নিজেদের সৎ ও যোগ্য ভাবতেও তাদের লজ্জা করে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু তা উদাহরণ দেওয়ার মতো নয়।
এ পরিস্থিতি উত্তোরণের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মাঝে তার বিবেক, মানুষত্ববোধ, মানবিকতাকে জাগ্রত করে তোলা। যখন সে বুঝবে অন্যকে ঠকিয়ে কিংবা অবৈধভাবে উপার্জন করা সম্মানের নয় বরং অপমানের, তখন সে এগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক হবে তখন ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির ওপর ভিত্তি করে। একে অন্যের সুখ-দুঃখ তখন ভাগাভাগি করে নেবে নিজেরাই। মালিক কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেতন কিংবা বোনাস দিতে না পারলে শ্রমিকরা তখন মালিককে অন্তত বাধ্য করবে না। আবার মালিক যখন বা যে বছর বেশি মুনাফা করবে তখন শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কোনো বোনাস কিংবা অনুষ্ঠান বা ভোজের আয়োজন করলে তখন মালিকের প্রতি শ্রমিকদের একটা বিশ্বাস তৈরি হবে। তখন শ্রমিকরাই ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব শুধু নেবে না বরং তার উন্নতির জন্য আরও সচেতন হবেÑ সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এই বোধ সৃষ্টি তো এমনি এমনিতে হবে না। তার জন্য লাগবে শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। সেই শিক্ষা মানব মস্তিষ্ক প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে না, পারবেও না। কারণ হলো, এখানে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নকারীদের নিজস্ব সীমাবদ্ধ জ্ঞান, পার্থিব উদ্দেশ্য, দর্শন ও মুনাফা জড়িত থাকে। আর তাই যখনই এসব শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা হয়েছে তখনই তা হিতে বিপরীত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় কীভাবে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদের উত্থান হয়েছিল এবং কীভাবে তা আবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে। এভাবে মানুষের তৈরি করা মতবাদ ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে একের পর এক।
এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায় সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রণিত বিধান এবং তার শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ ধর্ম, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে মনোনীত (সূরা আলে ইমরান ৩ : ১৯) এবং পূর্ণাঙ্গ ধর্ম ইসলাম (সূরা মায়েদা ৫ : ৩) ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক এবং তাদের একে অপরের অধিকার ও কর্তব্যকে উপযোগী ও কল্যাণকরভাবে উপাস্থাপিত হয়েছে। উভয় পক্ষকে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণের মধ্য দিয়ে তা নিশ্চিত করেছে। উভয়েরই সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণœ রেখেছে যথাযথভাবে। শ্রমিকের মর্যদা বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের কাছে তার চেয়ে কোনো উত্তম উপার্জন নেই, যা সে নিজের হাতে উপার্জন করে খায়। সে যা কিছু নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য ও ঘরের ভৃত্যদের জন্য খরচ করে তা সবই সদকা।’ (বোখারি)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, শ্রমিকরা হলো আল্লাহর বন্ধু। (দেখুন : কানযুল উম্মাল, খ- ৪, পৃ. ১২৭)। অধিকার যেন খর্ব না হয় তার বিধি-বিধান করে দেওয়া হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা যায় তাহলে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী মীমাংসা করে নাও।’ (সূরা আন নিসা ৪ : ৫৯)। এখন আমাদের দেশে মালিক-শ্রমিকের বিরোধের সবচেয়ে কমন কারণ হলো বেতন-বোনাস ঠিক মতো না দেওয়া। এক্ষেত্রে রাসুল (সা.) এর নির্দেশ হলোÑ ‘তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তাদের মজুরি দিয়ে দাও।’ (মিশকাত : ১৯৮৭)। বেতন নির্ধারণের সময় মালিক ও তার ব্যবসার অবস্থা বিবেচনায় যেমন নিতে হবে, তেমনি শ্রমিকের যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রয়োজন বিবেচনায় নিতে হবে। উভয় পক্ষের পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিলে তা বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। হজরত ওমর (রা.) এভাবে বেতন নির্ধারণ করতেন। (দেখুন : হিফজুর রহমান, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পৃ. ৭৮)।
অন্যদিকে, নিয়োগপ্রাপ্তির পর শ্রমিকের সাধ্যের বাইরে কিংবা চুক্তির কষ্টকর কোনো কাজে বাধ্য করা যাবে না। এটি আল্লাহর সুন্নতের বিরুদ্ধ। কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের দায়িত্ব দেন না।’ (সূরা বাকারা ২ : ২৮৬)।
একটা কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, এই জীবন আসল জীবন নয়। আমাদের মৃত্যুর পরের জীবনটিই আসল জীবন। (দেখুন : সূরা বাকারা ২ : ২৮)। সেই জীবনে সম্মান-মর্যাদার মাপকাঠি হবে ‘তাকওয়া’ (আল্লাহভীতিতে তাঁর আদেশ ও নিষেধকে যথাযথভাবে পালন করা)। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি সম্মানিত, যে অধিক তাকওয়াবান।’ (সূরা হুজুরাত ৪৯ : ১৩)।
আসুন আমরা ইসলামের শিক্ষার আলোকে আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই। সত্যিকার অর্থেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মালিক-শ্রমিকের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পাবেÑ এটাই হোক এবারের মে দিবসের প্রতিজ্ঞা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।