দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত জোগাতে রোজ ভোরে সাইকেল চালিয়ে রাজশাহী মহানগরীর রেলগেটে আসেন মজিবর রহমান। সঙ্গে থাকে ডালি আর কোদাল। নগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়ি বাইপাসের বাসিন্দা মজিবরকে রেলগেট থেকেই কাজের জন্য বিভিন্নজন নিয়ে যান। কাজ শেষে তার বাড়ি ফিরতে প্রতিটা দিনই রাত হয়ে যায়। আবার সূর্য ওঠার আগেই কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন মজিবর।
হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে ব্যস্ত থাকা মজিবর এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। দীর্ঘ ২৫ বছরের শ্রমিক জীবনেও জানতে পারেননি তার ন্যায্য অধিকার, কর্ম ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা। তিনি বলেন, কাজ করি, দুই পয়সা আয় হয়। এ দিয়েই সংসার চলে। একদিন কাজ না করলে পরের দিন পার করাটাই কঠিন। তাই কাজের বাইরে অন্য কিছু ভাববার সময় নাই। পারিশ্রমিক ছাড়া আর কি-ইবা পাওনা তা জানি না।
শুধু মজিবর একা নন, এমন গল্প রাজশাহীর হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের। কলকারখানা বা পথঘাটে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকলেও তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি। নানাভাবেই খর্ব হচ্ছে তাদের অধিকার। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতেও কাউকে দেখা যায় না। এ অবস্থায় আজ বুধবার সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবেই পালিত হয় দিনটি। তবে এখনও শ্রমিকরা কতটুকু তাদের অধিকার বুঝে পান বা বুঝিয়ে দেওয়া হয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
নগরীর ভদ্রা এলাকার একটি ওয়ার্কশপে কাজ করেন আফসার আলী। তিনি বলেন, এভাবে ১৮ বছর ধরে কাজ করে আসছি। হাতে লাগে, পায়ে লাগে। রডের আগুনের ফুলকি পড়ে। ফোসকা পড়ে। মালিক কোনো ক্ষতিপূরণ দেয় না। চিকিৎসাও করতে হয় নিজের পারিশ্রমিকের টাকা থেকে। আমাদের আবার অধিকার কী? মালিক তো খোঁজ নেন না, অন্য কেউও কখনো খোঁজ নিতে আসেনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, শ্রমিকদের নায্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার মতো মানসিকতা সব মানুষেরই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে শ্রমিকরাও অসচেতন। তাই অধিকার যেন শ্রমিকরা বুঝে নিতে পারেন সে জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাদেরও সচেতন করে তুলতে হবে। এ জন্য তাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিকদের পেশাগত বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ১৯৮১ সালে নগরীর তেরখাদিয়া এলাকায় চালু হয় রাজশাহী শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন। কিন্তু প্রশিক্ষণার্থী না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, প্রশিক্ষণ চলাকালে শ্রমিকদের দৈনিক মাত্র ১৫০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়। এ টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। তাই সংসার ফেলে কেউ প্রশিক্ষণ নিতে যেতে চান না।
রাজশাহী হোটেল ও রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ভাতা কম হওয়া ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ না করায় প্রশিক্ষণ নিয়ে আগ্রহ নেই নি¤œ আয়ের শ্রমিকদের। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকার আদায় এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন আছে, এটা শ্রমিকরা জানেন। কিন্তু কেউ তাদের সেই আইন শেখাবে এ সুযোগ কম। ফলে এগুলো নিয়ে আর কেউ ভাবেন না।
শ্রম অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে শ্রমিক সংগঠনের সদস্য রয়েছেন প্রায় ৪ লাখ ৩৮ হাজার। রজশাহী শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনের উপপরিচালক মনিরুল আলম বলেন, প্রতি অর্থবছরে শিল্প সম্পর্কবিষয়ক দুটি এবং শ্রম অধিকার ও আইনবিষয়ক ১০ থেকে ১২টি এক সপ্তাহ মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স তারা পরিচালনা করে থাকেন। তবে সব শ্রমিক এ প্রশিক্ষণ পাননি।
মনিরুল আলম বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকা ভাতার পরিমাণটা খুবই সামান্য। এ টাকায় কোনো শ্রমিকেরই সংসার চলবে না। তাই কাজ বাদ দিয়ে এ প্রশিক্ষণের দিকে শ্রমিকদের আগ্রহ কম। এ জন্য আমরাও চাই, প্রশিক্ষণের ভাতাটা বৃদ্ধি করা হোক। তাহলে শ্রমিকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রতি আগ্রহী হবেন। প্রশিক্ষণ নিলে আইন-কানুন বুঝে তারা তাদের নায্য অধিকার বুঝে নিতে শিখবেন।