তাদের ঘামের বিনিময়ে অর্জিত অর্থে চলে সংসার। চলে দেশও। অথচ ন্যায্য অধিকার ফিরে পাননি শ্রমজীবী মানুষ। সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে আছেন তারা। ছবিটি মঙ্গলবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া থেকে তোলা ষ আলোকিত বাংলাদেশ
- ন্যূনতম মজুরিও নেই ৮৫ শতাংশ শ্রমিকের
- খাটুনি বেশি, মজুরি কম
- শ্রমের প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধি কমছে
- বেশির ভাগ শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে
দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন তৈরি পোশাক খাত মজুরির দিক থেকে অনেক বেসরকারি খাতের তুলনায়ও পিছিয়ে রয়েছে। রপ্তানি আয়ের শীর্ষে থাকা এ শিল্পের ন্যূনতম মজুরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি থেকেও ৪৫ শতাংশ কম। তবে পোশাক খাতে মজুরির নির্ধারিত হার থাকলেও দেশের এমন শতাধিক খাত রয়েছে, যেগুলোর শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি; এমনকি স্থায়ী মজুরির কথা ভাবতেও পারেন না। অথচ এমন শ্রমিকের সংখ্যা দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় ৮৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি শুধু তার মজুরিই নয়, শোভনভাবে জীবন ধারণের অন্য অনুষঙ্গও এতে অন্তর্ভুক্ত, যার বেশিভাগই পান না এদেশের শ্রমিকরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের খাটুনি বেশি হলেও মজুরি সে তুলনায় বেশ কম। আবার মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে এদেশের মজুরি প্রবৃদ্ধি কমছে বলেই মনে করে সংস্থাটি। এ অবস্থায় আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৯’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের উৎপাদনশীল খাত, অর্থাৎ কলকারখানার ৪৫ শতাংশের বেশি শ্রমিককে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম দিতে হয়। প্রতিযোগী ও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশ কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, মঙ্গোলিয়া ও ভিয়েতনামে এ হার কম। উৎপাদনশীল খাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশের বেশি পরিবহন শ্রমিককে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়। এদিক থেকে ওই ছয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে আছে শুধু মঙ্গোলিয়া। তবে আইএলওর প্রতিবেদনে শ্রমিকের কর্মসংস্থানের মানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, নিম্নমানের কর্মসংস্থান বৈশ্বিক শ্রমবাজারের জন্য এখন মূল সমস্যা। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ নিম্নমানের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ কারণে ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ৩৩০ কোটি কর্মরত মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা ছিল না। তারা সমান সুযোগ পাননি। পর্যাপ্ত পণ্য ও সেবা কেনার সক্ষমতাও তাদের ছিল না।
আইএলওর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে সংস্থাটির উপমহাপরিচালক ডেবোরাহ গ্রিনফিল্ড বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৮ নম্বর লক্ষ্যে শুধু কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা নয়, মানসম্মত কাজের কথা বলা হয়েছে। সমান সুযোগ ও শোভন কাজ এসডিজি অর্জনের দুটি মূল ভিত্তি। আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি কাজ পাওয়া মানেই শোভন জীবন ধারণের সুযোগ, অনেক দেশেই বিষয়টি সে রকম নয়। অনেকেই বাধ্য হয়ে নিম্নমানের কাজ করেন। অনেকেই খুব কম মজুরি পান। সামাজিক সুরক্ষা বলতে কিছু থাকে না, থাকলেও সেটা নগণ্য। ২০১৮ সালের হিসাবের ভিত্তিতে আইএলও জানায়, স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশে চার ভাগের এক ভাগের বেশি কমর্রত শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। আর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় শ্রমিকদের বড় অংশ কৃষি থেকে শিল্পের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কাজের মান তেমন একটা বাড়ায়নি। শ্রমিকের বড় অংশই এখনও চাকরির নিরাপত্তা, লিখিত চুক্তি, আয়ের স্থিতিশীলতার অভাবে ভোগেন। আইএলওর প্রতিবেদনে দিনে ৮ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে তাকে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ শ্রমিককে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিগত দশকগুলোয় কর্মসংস্থান, নারীর অংশগ্রহণ ও মজুরির সমন্বয় হয়েছে। তবে কর্মপরিবেশ এবং শ্রম অধিকার; বিশেষ করে তাদের সংগঠন কারার অধিকারের ক্ষেত্রে মিশ্র অভিজ্ঞতা রয়েছে। কর্মপরিবেশের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতের অগ্রগতি হলেও অন্যান্য খাতের অবস্থায় একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি। এখন প্রয়োজন অন্যান্য খাতে আন্তর্জাতিক মানদ- প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ নিতে হবে। যে জায়গাগুলোয় উন্নতি হয়নি, বরং কমেছে তা হলোÑ শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, তৈরি পোশাক শিল্পেও এটা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। শ্রমিকদের শোভন কাজের অংশ হিসেবে এগুলো সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে শুধু মজুরি দিয়ে বা শুধু কর্মসংস্থান দিয়ে তাদের প্রকৃত উন্নয়ন বা অধিকার নিশ্চিত করা কষ্টকর হবে।
গত নভেম্বরে প্রকাশিত আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শ্রমের প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধি কমছে। মোট মজুরি থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে যা থাকে, তা-ই প্রকৃত মজুরি। ২০১৩ সালেও দেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালে তা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার বার্ষিক গড়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রকৃত মজুরি বেড়েছে বার্ষিক গড়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। যদিও বাংলাদেশে বেড়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। একই সময়ে প্রতিবেশী ভারতে ৫ দশমিক ৫, শ্রীলঙ্কায় ৪, নেপালে ৪ দশমিক ৭ এবং পাকিস্তানে বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। অর্থাৎ মজুরি বৃদ্ধির হারে পাকিস্তান বাদে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।
আইএলওর তথ্যানুযায়ী, এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৫ সালে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশে। পরের বছর এ হার আরেকটু বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশে নেমে আসে। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মজুরি ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এটা সরকারি-বেসরকারির পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের মধ্যেও রয়েছে। এটা নির্ভর করে খাতের সক্ষমতা, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা, আন্তর্জাতিক বাজারে সংযোগ, উদ্যোক্তাদের মুনাফা করার সুযোগ ইত্যাদির ওপর। তবে ন্যূনতম তাদের জীবনমানের জন্য যা দরকার, সেটি এখনও সবচেয়ে সক্ষম খাত তৈরি পোশাকেও নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক খাতে ন্যূনতম মজুরিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। মজুরিবহির্ভূত অন্যান্য সুবিধা; যেমন শ্রম অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান, তাদের শিক্ষার জন্য সরকারি স্কুল, স্বাস্থ্যের জন্য মানসম্মত সরকারি হাসপাতাল, বিনোদনের ব্যবস্থা এখনও অনেক কম। এগুলোর ওপর সরকার নজর দিলে তাদের ব্যয় কমে বিদ্যমান আয় দিয়েই তারা আরও একটু ভালো থাকতে পারে।
দেশীয় গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য মতে, সরকারি ন্যূনতম মজুরির তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে প্রায় সব বেসরকারি খাত। এমনকি বেসরকারি বিভিন্ন খাতের মধ্যেও মজুরি বৈষম্য রয়েছে। জাতীয় বেতন কাঠামোয় সর্বনিম্ন স্তরের মজুরি ১৪ হাজার ২৫০ টাকা। এ হিসাবে এর আওতাভুক্ত কলকারখানার শ্রমিক থেকে পোশাক খাতের শ্রমিকরা ৪৫ শতাংশ কম বেতন পান। পোশাক খাতের সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার টাকা। হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাতে ঘোষিত মজুরি ৩ হাজার ৭১০ টাকা। সরকারি পে-স্কেলের সঙ্গে পার্থক্য ১১ হাজার ৫৪০ টাকা বা ৭৫ শতাংশ। হোসিয়ারি শিল্পের মজুরি ৪ হাজার ৬৫০ টাকা। সরকারি পে-স্কেলের মধ্যে পার্থক্য ১০ হাজার ৬০০ টাকা বা ৭০ শতাংশ। দর্জি কারখানার মজুরি ৪ হাজার ৮৫০ টাকা। সরকারি পে-স্কেলের মধ্যে পার্থক্য ১০ হাজার ৪০০ টাকা বা ৬৮ শতাংশ। সোপ অ্যান্ড কসমেটিক খাতের মজুরি ৫ হাজার ৬৪০ টাকা। সরকারি পে-স্কেলের মধ্যে পার্থক্য ৯ হাজার ৬১০ টাকা। বিলস বলছে, দেশের নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের ৪১টি খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ট্যানারিতে ১২ হাজার ৮০০, জাহাজভাঙায় ১৬ হাজার, ওষুধে ৮ হাজার ৫০, চা প্যাকেটিংয়ে সাড়ে ৮ হাজার, কটন টেক্সটাইলে ৫ হাজার ৭১০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতমান, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের তুলনায় এ দেশের মজুরি কম, যা একজন শ্রমিকের জীবন ধারণের জন্য নিতান্তই অপ্রতুল।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, কোনো পরিবারের প্রতি সদস্যের দিনের গড় আয় ২ ডলারের নিচে হলে, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। সে হিসাবে, দেশের অধিকাংশ শ্রমিকের পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। আবার দেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় বিবেচনায়ও দরিদ্র অবস্থায় রয়েছেন শ্রমিকরা। বছরে প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডলার বা ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা গড় মাথাপিছু আয় হলেও সবচেয়ে বড় শ্রমঘন পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি হিসাব করলেও বছরে আয় হয় ১ লাখ টাকার কাছাকাছি।