আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৩-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

প্রযুক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার কৌশল নিতে হবে

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশেষ শিল্পাঞ্চল ও আইটি পার্ক গঠনের মাধ্যমে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটি অত্যন্ত আশাবাদী হওয়ার মতো একটি উদ্যোগ। তবে চীন যেহেতু ১৯৮০ সাল থেকে বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছে, তারা কীভাবে এ শিল্পাঞ্চলগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে, কী ধরনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে, সেটির অভিজ্ঞতা আমাদের শিল্পাঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া আজকের পৃথিবী অচল। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা করলেই হবে না, বরং কীভাবে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া যায়, সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমরা অর্থনৈতিক পরাশক্তির কথা বলি, সামরিক পরাশক্তির বিষয়ে আগ্রহ দেখাই; কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অন্যতম প্রযুক্তি পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটানো। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা অন্যতম প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারি। আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা এ বিষয়ে রয়েছে; তবে সেটা আরও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তিধর উন্নত রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের নিজের ভাবনার সঙ্গে তাদের ইতিবাচক ভাবনাগুলো যুক্ত করতে পারলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো সহজে অর্জন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে আমরা ইসরাইলের প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কৌশলটি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, মাত্র ৮০ লাখের একটু বেশি লোকসংখ্যার এ দেশে ৪ হাজারেরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। সিসকো, পেপাল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেইসবুক, অ্যাপল ও ইন্টেলের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো বহুলাংশে ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল। কারণ আগামী দিনে এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নতুন কী ধরনের পণ্য ও প্রযুক্তি আসবে তার ধারণা আসে ইসরাইলের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের গবেষণার মাধ্যমে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ৫০০ টেক-জায়ান্টের ৮০টিরও বেশি গবেষণাকেন্দ্র এবং নব্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কেন্দ্র ইসরাইলে রয়েছে। এ গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত ইসরাইলি প্রযুক্তিবিদ ও গবেষকরা পরবর্তী মডেলের আইফোনের হার্ডওয়্যার, গুগলের নতুন প্রযুক্তিগুলো যেমনÑ নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন চিপস ও অ্যাপস, চালকবিহীন গাড়ি, রোবট, গুগল লেন্স ইত্যাদি, ইন্টেলের নতুন প্রসেসর, মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ তৈরি করছে। এছাড়া সময়ের সঙ্গে এগুলোর পরিবর্তিত প্রযুক্তির নতুন ধারণার গবেষণাগুলোও করছে। প্রযুক্তি খাত থেকেই ইসরাইলের আয়ের অন্যতম বড় একটি অংশ আসে, যা ইসরাইলের জিডিপির ১২.৫ শতাংশ। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে ১০০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইসরাইলে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘ইয়জমা প্রোগ্রাম (উদ্যোগ)’ শুরু করে। এ প্রোগ্রামের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরাইল সরকার ১০০ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড তৈরি করে, যার মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ করলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ৪০ শতাংশ মালিকানা ইসরাইল তার নিজের হাতে রাখে। যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক ব্যবসা করতে পারে; তবে সামান্য সুদসহ সরকারের টাকা পরিশোধ করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির ১০০ শতাংশ মালিকানার অধিকারী হয়। অনেকেই ভাবতে পারে, যদি মালিকানা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই চলে যায়; তবে এতে ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। বিষয়টি আসলে এ রকম নয়। তাদের এ পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা দুটি বিষয়কে নিশ্চিত করতে পেরেছে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানগুলো যখন মালিকানা স্বত্ব পেয়ে যায়, তখন তারা আরও বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আবার অন্যদিকে এ ধরনের সুবিধা দেখে অন্য বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোও ইসরাইলে বিনিয়োগে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আরেকটি বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসরাইলিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং মালিকানা স্বত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্জিত ট্যাক্স ইসরাইলের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করেছে। আবার ইসরাইলিরা গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়ায় নতুন ধারণা বা আইডিয়া বিক্রি করেও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকে। ইসরাইল এখন উদ্যোক্তাদের নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীর জন্য প্রতি বছরে ১৫০ মার্কিন ডলার করে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরেকটি বিষয়কে ইসরাইলিরা প্রাধান্য দিয়েছে, তা হলো প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে তাদের দেশ প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এখানেও তাদের ক্রিয়েটিভ পরিকল্পনার বিষয়টি কাজ করেছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গতানুগতিক শিক্ষায়তন হিসেবে কাজ না করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। এ গবেষণার অর্থ দিয়ে থাকে বিভিন্ন বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো মৌলিক ও ফলিত গবেষণায় অর্জিত ফলাফল তাদের শিল্পের বিকাশে প্রয়োগ করে। অন্যদিকে ইসরাইলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি পেশাদার গবেষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে শিক্ষাজীবনের মধ্যে থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন আইডিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে বের হয়ে আসে। এর মাধ্যমে একেকজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরির কৌশলটি গুরুত্ব সহকারে ভাবা যেতে পারে। আবার প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিনিয়োগের কৌশলটি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করা যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার গবেষণার সংস্কৃতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে গবেষকদের অনুপ্রাণিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। 
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন না করে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। শুধু রুটিন দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আরও কী কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয়, সেটা চিন্তা করে সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি চাকরি যে একটা রুটিন চাকরি, আসলাম বেতন নিলাম চলে গেলামÑ সেটা নয়। নিজের ভেতরে উদ্ভাবনী শক্তি কী আছে, সেটাও কাজে লাগাতে হবে। নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। যেখানে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাকে সেখানে ভাবতে হবেÑ এটা আমার নিজের দায়িত্ব, কারণ এই দেশটা আমার, দেশের মানুষগুলো আমার। কাজেই দেশের মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে।’ এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ টু আইয়ের (একসেস টু ইনফরমেশন) মাধ্যমে সারা দেশের তরুণ প্রজন্ম যে কোনো বিষয়ে নতুন প্রযুক্তিগত ধারণা দিতে সক্ষম হচ্ছে। এ আইডিয়াগুলোকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে পারলে আমাদের দেশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে, অন্যদিকে তরুণরাও উৎসাহিত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যখন সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়েছে, তখন তারা ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। প্রযুক্তির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর নেতিবাচক ধারণায় তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করেনি, বরং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিককে পরিহার করে প্রযুক্তির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা এটি মোকাবিলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মূল মন্ত্র ছিল প্রযুক্তির ব্যবহার ধ্বংসের মাধ্যমে না হয়ে তা সৃষ্টির মাধ্যমে হতে হবে। এ কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, ‘এক গ্রাম এক পণ্য’ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। খুব কম মূল্যে দ্রুততর সময়ে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে হবে। বিষয়টি বিবেচনায় এনে তারা পণ্যভিত্তিক জনশক্তি গড়ার লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। মাত্র ২০ বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালে ৫৬ শতাংশ লোককে কারিগরি ডিপ্লোমা শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলে। এ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে সম্মিলিত মেধা, শ্রম, নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশীয় কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রের চিন্তাধারার বাস্তব প্রতিফলন ঘটায়। জাপানিরা প্রযুক্তির বিকাশে একক প্রচেষ্টার চেয়ে টিমভিত্তিক প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার, সেটি হলো কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। ইউরোপে রেনেসাঁর মাধ্যমে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছিল। সে সময় ইউরোপিয়ানরা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশায় অনুপ্রাণিত হয়ে গোটা পৃথিবীর প্রযুক্তির ধারণায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল কলোনিয়ালিজম। অনেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৪৯২ হলো ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এ শিল্পবিপ্লব থেকেও আমাদের দেশকে ধারণা নিয়ে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশেষ শিল্পাঞ্চল ও আইটি পার্ক গঠনের মাধ্যমে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটি অত্যন্ত আশাবাদী হওয়ার মতো একটি উদ্যোগ। তবে চীন যেহেতু ১৯৮০ সাল থেকে বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছে, তারা কীভাবে এ শিল্পাঞ্চলগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে, কী ধরনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে, সেটির অভিজ্ঞতা আমাদের শিল্পাঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। এ শিল্পাঞ্চলগুলোর মাধ্যমে তারা দেশীয় প্রযুক্তিগত ধারণাগুলোকে হাতে-কলমে শেখা, এটিকে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তর ও তা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে সরকার, শিল্পকারখানা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রিত করে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অন্য যে রাষ্ট্রগুলো রয়েছে, তারা কীভাবে প্রযুক্তির পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে বিচার-বিবেচনা ও গবেষণা করে আমাদের দেশকেও পদক্ষেপ নিতে হবে; তবেই দেশ ও মানুষ এগিয়ে যাবে। হ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
[email protected]