ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য শ্মশ্রুম-িত মঈন আলী
আল্লাহ তায়ালা নারী-পুরুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নারীর জন্য পুরুষের বৈশিষ্ট্য ধারণ করা এবং পুরুষের জন্য নারীর সদৃশ অবলম্বন করা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। দাড়ি পুরুষের বৈশিষ্ট্য এবং পৌরুষের প্রতীক। মাথার লম্বা চুল যেমন নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তেমনি পুরুষকেও সুন্দর মানায় তার লম্বা দাড়িতে। তাই তো নবী-রাসুল ও মুসলমানদের মতো যুগে যুগে মুসলিম পুরুষদের মুখেও শোভা পেয়েছে লম্বা দাড়ি। খোদাদ্রোহী ফেরাউন, আবুজাহল, আবুলাহাব প্রমুখের মুখেও দাড়ি ছিল। তবে ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান ফ্যাশন বা শখ হিসেবে নয়, বরং দাড়ি রাখা আল্লাহর রাসুলের নির্দেশ। অসংখ্য হাদিসে নবীজি (সা.) দাড়ি লম্বা রাখা এবং মোচ খাটো রাখার নির্দেশ প্রদান করেছেন। দাড়ি সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে ৬টি নির্দেশসূচক শব্দ বর্ণিত হয়েছে। তা হলোÑ ‘উফু’, ‘আওফু’, ‘আরখু’, ‘আরজু’, ‘ওয়াফফিরু’ ও ‘দা-ঊ’। সবক’টি শব্দের মর্মার্থ হচ্ছেÑ ‘তোমরা দাড়ি লম্বা করো।’ তাই ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্য দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এটা শিয়ারে ইসলাম তথা ইসলাম ধর্মের ইউনিফর্ম এবং প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রতি ভালোবাসার স্পষ্ট নিদর্শন। দাড়ি কাটা ও মু-ন করা মস্তবড় গোনাহ। ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, দাড়ি মু-ানো চব্বিশ ঘণ্টার গোনাহ। অর্থাৎ দাড়ি কাটার পর থেকে এক মুষ্টি হওয়া পর্যন্ত এ গোনাহটি তার সঙ্গে লেগে থাকে। এ হিসাবে দাড়ি কামানোর গোনাহ জেনা-ব্যভিচার, চুরি, হত্যা, মদপান ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক। তাই তো নবীযুগে এমন কোনো মুসলমান খুঁজে পাওয়া যায় না, যিনি দাড়ি রাখতেন না বা কর্তন করে রাখতেন।
দাড়ি রাখা আল্লাহর নির্দেশ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসুল যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং তিনি যা কিছু নিষেধ করেছেন তা তোমরা বর্জন করো।’ (সূরা হাশর : ৭)। রাসুল (সা.) নিজে দাড়ি রেখেছেন এবং উম্মতকে দাড়ি রাখতে নির্দেশ করেছেন। সুতরাং এই নির্দেশ আল্লাহরই নির্দেশ। তাছাড়া একটি হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার রব আমাকে দাড়ি লম্বা করতে এবং মোচ খাটো রাখতে আদেশ করেছেন।’ (আওজাযুল মাসালেক : ১৫/৬)।
দাড়ির পরিমাণ এক মুষ্টি
ইসলাম ধর্মে এক মুঠ পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এক মুঠের অরিতিক্ত অংশ রাখা ওয়াজিব নয়। বরং ওই অতিরিক্ত অংশটি কেটে-ছেঁটে দাড়িকে পরিপাটি করে রাখা সুন্নত। এটা রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকেও এক মুষ্টি দাড়ির প্রমাণ পাওয়া যায়। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে তাওরাত কিতাব এনে দেখেন তার সম্প্রদায় বাছুর পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তার স্থলাভিষিক্ত ভাই হারুন (আ.) এর দাড়ি ধরে টান দেন। এ ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবেÑ ‘হে আমার মায়ের পুত্র! আপনি আমার দাড়ি ও মাথা ধরবেন না।’ (সূরা তাহা : ৯৪)। এ থেকে বোঝা যায়, হারুন (আ.) এর দাড়ি এক মুঠের কম ছিল না। কেননা দাড়ি মুষ্টি পরিমাণের কম হলে ধরা সম্ভব হয় না।
দাড়ি পরিপাটি করে রাখা সুন্নত
রাসুলুল্লাহ (সা.) মাথার চুল এবং দাড়িতে তেল লাগাতেন। চিরুনি দিয়ে চুল, দাড়ি পারিপাটি করে রাখতেন। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাথায় লম্বা চুল (বাবড়ি) রাখে সে যেন তার যতœ নেয়।’ অর্থাৎ তেল ও চিরুনি দ্বারা সুন্দর করে রাখে। হজরত আতা ইবনে ইয়াসার বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি চুল-দাড়ি এলোমেলো অবস্থায় মসজিদে হাজির হলো। নবীজি (সা.) তাকে বললেন, যাও চুল-দাড়ি সুন্দর ও পরিপাটি করে এসো। লোকটি চিরুনি দ্বারা চুল-দাড়ি পরিপারি করে উপস্থিত হলে নবীজি (সা.) বললেন, একে এখন কত সুন্দর লাগছে। আগে এলোমেলো চুল নিয়ে আসায় তাকে শয়তানের মতো দেখাচ্ছিল।’ (মুয়াত্তা : ১৪৯৪)। চুল-দাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রিয়নবী (সা.) এর দায়েমি সুন্নত।
দাড়ি রাখার দৈহিক উপকারিতা
আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি বিধান এবং মহানবী (সা.) এর প্রত্যেকটি সুন্নাহ মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণকর। আজকের বিজ্ঞান সেসব কল্যাণের কিছু কিছু আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করছে। নবীজির সুন্নাহ নিয়ে যতই গবেষণা হচ্ছে ততই বের হয়ে আসছে নতুন নতুন উপকারী তথ্য। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, নবীজির সুন্নাহ ও আল্লাহ তায়ালার বিধান বিবেকপ্রসূত বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর নয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ইসলামের কোনো একটি বিধানের অকল্যাণ ধরা পড়লে তা অকার্যকর বা পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে না। বরং ধরে নিতে হবে গবেষণার ফলাফল ভুল হয়েছে। দাড়ি সম্পর্কে সুইজারল্যান্ডের একটি অখ্যাত ক্লিনিকের গবেষণার সত্যতা পাওয়া যায়নি অন্যদের গবেষণায়। দাড়ি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালের গবেষণার ফলাফল ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশনে’ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দাড়িওয়ালাদের চেয়ে বরং দাড়ি কামানো পুরুষের মুখেই বেশি রোগ-জীবাণু পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলেছেন, মেথিসিলিন-রেসিস্ট্যান্ট স্ট্যাফ অরিয়াস (এমআরএসএ) বলে যে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী, সেটি দাড়িওয়ালাদের চেয়ে দাড়ি কামানোদের মুখে তিনগুণ বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে। এর কারণ কী? গবেষকরা বলেছেন, দাড়ি কামাতে গিয়ে মুখের চামড়ায় যে হালকা ঘষা লাগে, তা নাকি ব্যাকটেরিয়ার বাসা বাঁধার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। অন্যদিকে দাড়ি সংক্রমণ ঠেকাতে সাহায্য করে।’ (সূত্র কালের কণ্ঠ, ১৯-০১-২০১৬)।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের প্রফেসরের করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘মুখের দাড়ি সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে। এতে মুখম-ল সুরক্ষা পায়। এমনিভাবে দাড়ি ত্বক সজীব রাখে এবং ত্বকে ভাঁজ পড়া থেকেও রক্ষা করে। এছাড়া দাড়িওয়ালা ব্যক্তিদের স্কিন ক্যান্সারের মতো রোগ হওয়া থেকেও অনেকটা রক্ষা করে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭-৪-২০১৯)।
আরেকটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, লম্বা দাড়িতে পুরুষকে শুধু সুদর্শনই দেখায় না, দাড়ি পুরুষদের স্বাস্থ্যবান রাখতেও সাহায্য করে। প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসকরা দাড়ি সম্পর্কে গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, লম্বা ও ঘন দাড়ি গলাকে শীত-গরমের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখে। দাড়ি পায়রিয়ার মতো মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এবং দাড়ি মর্দামি শক্তি বৃদ্ধি করে। (সূত্র : মজলুম দাড়ির ফরিয়াদ)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী